রুদালি
বৃষ্টি আসতে ঢের দেরি।
চুলোর উপর মাটির হাঁড়িতে গঙ্গাজল। ভাঙা চাল আর খুদকুঁড়ো একসাথে উত্তাপ নিচ্ছে... আর কালো ডাহুকের মতো আমাদের ছেলেমেয়েগুলো একচোখ তেষ্টা নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। ফ্যান উথলে পড়ার সাথেসাথেই ওদের উপোসি জিভ চেটে নেবে সেই গলন্ত মোমের অমৃত
কারো বাড়ি হাহাকার ওঠার আগেই আমরা মঞ্চ বেঁধে ফেলি। বুকের কাপড়ে জড়িয়ে নিই সন্তানের ওম, শিকনি, দেয়ালার কান্না... যেমন কালবৈশাখী আসার আগেই গুছিয়ে নিতে হয় গেরস্থের উঠোন, কুয়োতলা। আমাদের কালোপাড় শাড়িগুলো খটখটে রোদ ভেঙে বুকে উঠে আসে। মূর্তিমতী শোকচিহ্ন তারা...
নিজের ঘরের জন্য কাঁদার সময় কই? অনাবাদি শুখা মরশুমে অপচয় সহ্য হবেনা। হাঁড়ির টগবগ শব্দে উপবাসী মরাগুলো কান পেতে থাকে। প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে ফুটে ওঠে সাদা ফেনা, কান্না চাপা দেওয়া গঙ্গাজল। এই আকালের দিনে কার জন্য ছাতি চাপড়ে বৃষ্টি আনাবো?
অনিন্দিতা'কে
সুরেন ব্যানার্জি থেকে হেঁটে আসছি, বাসে কিংবা ট্রামে
ভদ্দরলোকের মতো বসতে পারিনি। অনিন্দিতা,
পৃথিবী প্রদক্ষিণে যেতে হবে আমাকে এখন
তোমার কোলের শিশু কোলেতে ঘুমোচ্ছে...
তাকে স্তন দিও। পিতৃনাম দিও।
উড়নচণ্ডী হাওয়া জন্মসূত্রে সে যেন না পায়
ভালোবাসা কোনোদিনই ভরকেন্দ্রে টেনে নেয়নি, জানো!
ছিটকে ফেলেছে সেই পরিধিতে, কাদায়, পাথরে
হাঁটু ছড়ে গেছে। আমি ফিরেছি একাকী, সেবাহীন
ক্যানভাস জুড়ে রক্ত... কেরানির শিরাকাটা ছবি
সুরেন ব্যানার্জি থেকে থিয়েটার রোড বহুদূর
পথে কোনো গাছ নেই। পথে কোনো জলসত্র নেই।
তোমার ছায়ার মতো ঘাসবন
অলীক কল্পনা
এদেশে চাকুরিসীমা এখনো চল্লিশ, ন্যূনাধিক
প্রেমের বয়স। তাই ফুরিয়ে যাওয়ার কিছু আগে
পৃথিবী প্রদক্ষিণে যেতে হবে অনিন্দিতা, তুমি
ছেলের দোহাই, এই কেরানিকে গৃহটি দিও না।
তর্পণ
ভাতের হাঁড়ির মধ্যে বেলা পড়ে যায়
তুমি বুঝতে পারো না...
অন্ধকারে জল থেকে উঠে আসে পুরোনো কাঠামো
একপেট খিদে নিয়ে গেরস্থের শান্ত ঢেঁকিঘরে
সে দাঁড়িয়ে থাকে, আর
ঘাটের শিথানে ভাসে জবাফুল, মরা চাঁদমালা
ঘন পুকুরের জলে মেয়েটির প্রতিবিম্ব
ভেঙেচুরে দেয়
জেলেনৌকোর ওই রোগাটে হিংস্র সাদা কুপি;
অথচ বছর দুই আগে
নিথর শরীর তার এখানেই ভেসে উঠেছিলো -
এখনো চাঁদের নীচে শ্যাওলায়
জড়িয়ে রয়েছে সরু পায়ের নূপুর
খিদে নিয়ে যদি সেও খিড়কির ঘাটে উঠে আসে?
তুমি কি ডাকবে না তাকে কলাবউ-স্নান শেষ করে?
তুমি কি খাওয়াতে বসে
সোহাগি ভাতের পাশে একমুঠো ছাই বেড়ে দেবে?