“সুবর্ণজয়ন্তী হোক বা হীরকজয়ন্তী— বাংলার ইতিহাসে কোনো নাট্যদল থেকেই কিন্তু কোনো প্রদর্শনীর আয়োজন হয়নি এর আগে। হলেও, নাটককে কেন্দ্র করে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারির মতো জায়গায় প্রদর্শনী এই প্রথম। আমরাই শুরু করলাম এইধরনের কাজ”, বলছিলেন পিপলস লিটল থিয়েটার অর্থাৎ ‘পিএলটি’ নাট্যদলের সহ-সম্পাদক কমলেশ চক্রবর্তী।
চল্লিশের দশকের শেষ দিক সেটা। উৎপল দত্তের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নাট্যদল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’। ১৯৭১ সালে যা নবরূপে রেজিস্ট্রেকৃত হয় ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ বা ‘পিএলটি’ (PLT) নামে। সেই হিসাব ধরলে গত ২০২১ সালে ৫০-এ পা দিয়েছিল ঐতিহাসিক এই নাট্য সংস্থাটি। তবে শুধু প্রতিষ্ঠাদিবসেই পঞ্চাশ-পূর্তির উদযাপন নয়, বরং দীর্ঘ এক বছর ধরে সেই উৎসব যাপন করে চলেছে পিএলটি। এবার সেই উপলক্ষেই কলকাতার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে শুরু হল এক বিশেষ প্রদর্শনী— ‘পিএলটি’স রিভোলিউশনারি থিয়েটার’। গত ৪ এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে এক সপ্তাহব্যাপী এই বিশেষ প্রদর্শনী। চলবে আগামী ১০ তারিখ পর্যন্ত। থাকছে না কোনো টিকিটের ব্যবস্থাও। সকলেরই অবাধ প্রবেশ।
“পিএলটি-র পুরনো প্রযোজনাগুলোর কিছু দুষ্প্রাপ্য ফটোগ্রাফ থেকে শুরু করে ‘কল্লোল’-সহ অন্যান্য পুরনো নাটকের টিকিট, ব্রোসিওর ইত্যাদি নানান সামগ্রী রয়েছে এই প্রদর্শনীজুড়ে। কিছু নাটকের দুষ্প্রাপ্য ভিডিও ক্লিপিংসও দেখা হচ্ছে ফাইন আর্টসের সেন্ট্রাল গ্যালারিতে”, জানালেন কমলেশবাবু। বলাই বাহুল্য, এই প্রদর্শনীতে বিভিন্নভাবে ধরা পড়েছে পিএলটি-র অন্যতম প্রাণপুরুষ উৎপল দত্তের অভিনয়-মুহূর্ত, পরিচালনার নানান দৃশ্য।
কথায় কথায় জানা গেল, প্রাথমিকভাবে গত ডিসেম্বর মাসে এই প্রদর্শনী আয়োজনের পরিকল্পনা ছিল পিএলটির। তবে আর্থিক সমস্যাজনিত কারণে সে-সময় সম্ভব হয়ে ওঠেনি এই প্রদর্শনীর আয়োজন। পিছিয়ে যায় সূচি। কমলেশবাবু জানালেন, “পশ্চিমবঙ্গ নাট্য অ্যাকাডেমির কাছ থেকে আমরা অনুদানও পেয়েছি এই প্রদর্শনীর জন্য। সেটা সামান্য হলেও সাহায্য প্রদান করেছে তো বটেই।”
তবে শুধুই কি নাট্য প্রদর্শনী? সুবর্ণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে গত একবছর ধরে উৎসব যাপনের একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে পিএলটি। উৎপল দত্তের নির্দেশিত ও অভিনীত একাধিক দুষ্প্রাপ্য নাটকের ডিজিটাল স্ক্রিনিং অর্থাৎ অনলাইন নাট্য-প্রদর্শনী ছাড়াও, বিভিন্ন আলোচনা-সভা, রবীন্দ্রসদনে পাঁচদিন ব্যাপী নাট্যোৎসব, ছোটোদের জন্য কর্মশালা-সহ একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল পিএলটি। বাংলার বুকে পিএলটি ছাড়া অন্য কোনো নাট্যদলের ক্ষেত্রে এহেন বছরব্যাপী সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনও কি লক্ষ্য করা গেছে এর আগে? হয়তো না।
এখানেই শেষ নয়। গত ২৯ মার্চ, উৎপল দত্তের জন্মদিন উপলক্ষে, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে নতুন মোড়কে উপস্থাপিত হয় ‘ব্যারিকেড থেকে ব্যারিকেড’ নাটকটি। উৎপল দত্তের লেখা ও অভিনীত মূল ‘ব্যারিকেড’ নাটকটিকে সামনে রেখেই নতুন নাটকটি রচনা করেছেন হর ভট্টাচার্য। পরিচালনায় কমলেশ চক্রবর্তী। হিটলারের জার্মানি থেকে শুরু করে আজকের ভারতবর্ষ— বাঁধা পড়েছে এই নাটকে। মিলে-মিশে একাকার দিল্লির কৃষক আন্দোলন, মুম্বাইয়ের ৯/১১-র হামলা, মইদুল হত্যার মতো ঘটনাও। কমলেশবাবুর কথায়, “এটা অবশ্য একধরনের রি-ক্রিয়েশন, তবে সেটের ক্ষেত্রে সামান্য মডিফিকেশন-সহ আমাদের পুরনো ব্যারিকেডের সেটটাকেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি। এবং ভিডিও প্রোজেকশন থেকে শুরু করে যে মাল্টিমিডিয়ার কাজটা করা হয়েছে এই নাটকে, ঠিক ব্যারিকেডে যেমন উৎপল দত্ত একটা নতুন আঙ্গিক এনেছিলেন, তেমনই একটা নতুন আঙ্গিক তৈরি করার চেষ্টা করেছি আমরা।” ইতিমধ্যেই নাট্যপ্রেমীদের মধ্যে রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছে পিএলটির এই নতুন প্রযোজনা। আগামী ১৭ এপ্রিল অ্যাকাডেমিতে দ্বিতীয়বার প্রদর্শিত হতে চলেছে এই নাটক। সবমিলিয়ে ৫০ বছরে পা দিয়ে নানান আঙ্গিকেই এক নতুন মাইলস্টোন তৈরি করল ‘পিএলটি’, রচনা করল ইতিহাস…
ছবি ঋণ - অসীম পাল, পিএলটি
Powered by Froala Editor