‘কহিঁ দূর যব দিন ঢল যায়ে’ – গেয়েছিলেন মুকেশ; মৃত্যুও নেমে এল দেশের থেকে বহুদূরেই

বাইশ গজের যুদ্ধ চলছে। আন্তর্জাতিক নয়, ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট ম্যাচই। কিন্তু তাতেও আকর্ষণ কম নেই। বল করছেন এস চন্দ্রশেখর। উল্টোদিকের ক্রিজে সুনীল গাভাস্কার। জাতীয় দলে যতই সতীর্থ হন, এখন তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বী। ডেলিভারি এল; অফস্টাম্পের একটু বাইরে দিয়ে বেরিয়ে গেল বল। গাভাস্কারের চোখে একটু হতাশা। হঠাৎ ক্রিজে চন্দ্রশেখরের ফিসফিস আওয়াজ, ‘শুনা ক্যায়া?’ গাভাস্কারের চোখ চন্দ্রশেখরের দিকে। এতদিন ধরে খেলছেন, এই ইশারা বুঝে ফেলতে সময় লাগেনি। আবারও প্রশ্ন এল- ‘শুনা ক্যায়া?’ ব্যস! থেমে গেল ক্রিকেট। গাভাস্কার-চন্দ্রশেখর দুজনেই ধরলেন গান। ‘জিস দেশ মে গঙ্গা বহতি হ্যায়’। মুকেশ ছাড়া কি এক মুহূর্ত চলে…

একটা সময় হিন্দি সিনেমার জগতে কালজয়ী কথা আর কালজয়ী সুরের সঙ্গে একটাই নাম জুড়ে আছে— মুকেশ। ‘এক দিন বিত জায়েগা’, ‘কাহি দূর জব দিন ধল জায়ে’… লিস্ট শুরু করলে এত সহজে কি থামবে? আমাদের সবার জীবনের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে এসব? হ্যাঁ, এখনও, এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও একথা সমানভাবে সত্য। ঠিক কী ছিল তাঁর কথায়? জীবন? নয়তো পাহাড়ের এক কোণে বসে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে হতেই পারে এই জগত, এই ব্যস্ততা সব বৃথা। এই অপার শান্তিই সত্য, মুকেশ সত্য; আর পেছনে হালকা টোনে বেজে চলে ‘কাহি দূর জব দিন ধল জায়ে’… 

প্রথাগতভাবে সঙ্গীতের সেরকম কোনো তালিম ছিল না মুকেশের। ছিল এক দরদী গলা; ছিল এক ব্যর্থ হৃদয়, যাকে আপন করে নিয়েছিল আপামর ভারতবাসী। একটা অদ্ভুত সারল্য ছিল, যেটা সরাসরি মনে গিয়ে আঘাত দিত। যাকে বলে একেবারে গেঁথে দেওয়া। আর এটাই একজন মহৎ শিল্পীর গুণ। কোনো কারুকার্য নয়; সহজ, সাধারণভাবে নিজের জায়গাটুকু করে নিতে জানতেন মুকেশ। মনে পড়ে ‘পহেলি নজর’ সিনেমার কথা। সঙ্গীতের দায়িত্বে অনিল বিশ্বাস। তিনি চাইছেন সায়গলের যেমন গলার কাজ, যেমন দরদ, মুকেশেরও তেমন আসুক। এদিকে মুকেশ তখন চার বছর ধরে সংগ্রাম করছেন, সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে কিছু কাজ মিলছে। গান করছেন বটে; কিন্তু প্রোডিউসার মাজহার খানের কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। শেষে মুকেশ বললেন আপনি শুধু প্রথম দিনের জন্য রাখুন গানটা। দর্শকের যদি ভালো না লাগে তাহলে ছুঁড়ে ফেলে দেবেন। প্রথম দিনেই এত ভালো লেগে গেল সবার, যে প্রোডিউসার আর সাহসই পেলেন না কিছু করার। গানটা ছিল ‘দিল জ্বালতা হ্যায় তো জ্বালনে দে’।    

মুকেশ আর রাজ কাপুর— দুজনের জুটি একের পর এক হিট গান দিয়েছে। পরিসংখ্যানের হিসেবে দেখলে, মুকেশ তাঁর জীবনের প্রায় ১১৯টি প্লেব্যাক রাজ কাপুরের সঙ্গে করেছেন! ‘মেরা নাম জোকার’ সিনেমায় গানের কথাকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। শোনা যায়, ওই সিনেমায় মুকেশের গান রাশিয়ায় ভারতের প্রায় জাতীয় সঙ্গীতের মতোই ছিল। ‘জানে কাহাঁ গয়ে ওহ দিন’ আজও আমাদের দুঃখের দিনের সঙ্গী। যেদিন মুকেশ মারা যান, খবর পাওয়ার পর স্তব্ধ হয়ে যান রাজ কাপুর। তারপর শুধু একটাই কথা বলেন, “আমি আমার আওয়াজ হারিয়ে ফেললাম।” শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সম্মান কোন পর্যায়ে গেলে একজন মানুষ এই কথাটা বলতে পারেন!

আগেই বলা হয়েছে, মুম্বইতে শুরুর কয়েক বছর অনেক লড়াই করতে হয়েছে মুকেশকে। তার মধ্যে গায়কের পাশাপাশি নায়কের ভূমিকাতেও নেমেছিলেন তিনি। হিন্দি সিনেমা ‘নির্দোষ’-এ অভিনয় করেছিলেন, সেখানেই গান ‘দিল হি বুজা হুয়া হো তো’। এটাই বলিউডে গাওয়া তাঁর প্রথম গান। সেদিনের মুকেশ পরে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পা দেন ‘জুতা হ্যায় জাপানি’র হাত ধরে। দিব্যি তো চলছিল সবটা। এত তাড়াতাড়ি কি চলে যাওয়ার কথা ছিল? ১৯৭৬ সাল, ২৭ আগস্ট। ছেলে নিতিনকে নিয়ে গেছেন আমেরিকা ট্যুরে। সঙ্গে আছেন লতা মঙ্গেশকর। একটা শো-তে লতাজি’র সঙ্গে একই স্টেজে ছেলেকে গাইতে দেখে কেঁদেই ফেললেন মুকেশ। ডেট্রয়েটে শো করার কথা ছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ঠান্ডা লেগে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। সবকিছু সময়মতো শুরু হল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। মাত্র ৫৩ বছর বয়সেই চলে গেলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়ক… 

সত্যিই কি গেছেন? এখনও রাত গভীর হলে যে ছেলেটা ছাদের ধারে বসে থাকে, হাতে গিটার নেয়; আর দূরে দাঁড়িয়ে থাকা শান্ত গাছের দিকে তাকিয়ে গাইতে থাকে ‘কভি কভি মেরে দিল মে খেয়াল আতা হ্যায়’… তখন মনে হয় মুকেশ আছেন! এই গানটি, এরকম আরও বহু গানের জন্যই তিনি আছেন এখনও… 

আরও পড়ুন
মৃত্যুর পরই যেন সম্প্রচারিত হয় এই গান, আকাশবাণীকে নির্দেশ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের

Powered by Froala Editor

More From Author See More