দারিদ্র্য, অশিক্ষাকে জয় করে পরিবেশ বাঁচানোর যুদ্ধে সামিল কোলাঘাটের শিশুরা

“আমরা যে জায়গাটায় থাকি, একসময় পুরো এলাকাটাই সবুজে পূর্ণ ছিল। আমাদের চোখের সামনেই সমস্ত গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। দূষণের বিষাক্ত বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।” বলছিলেন পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের ‘হৃদি পল্লব’ সংগঠনের কর্ণধার সৌম্যদীপ দাস। আজ বিশ্ব শিশু দিবসের সকালে তাই এলাকার কচিকাঁচাদের নিয়েই শুরু হয়ে গেল সেই সবুজকে ফিরিয়ে আনার কাজ। ‘হৃদি পল্লব’-এর উদ্যোগে শিশুরা নিজের হাতে চারাগাছ রোপণ করল রূপনারায়ণ নদীর পাড় ধরে। তবে এই উদ্যোগ শুধুই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি নয়। বরং এই ধরনের উদ্যোগগুলির মধ্যে দিয়ে শিশুদের মধ্যে প্রকৃত মানব চরিত্রের বিকাশ ঘটানোই লক্ষ্য। এমনটাই জানালেন সৌম্যদীপ। তাঁদের পাঠশালার নামও দিয়েছেন ‘মানুষ গড়ার পাঠশালা’।

গত ১ বৈশাখ ‘হৃদি পল্লব’-এর সদস্যদের উদ্যোগে শুরু হয় এই ‘মানুষ গড়ার পাঠশালা’। তবে সরকারের করোনাবিধির কারণে আবার সেই পাঠশালা বন্ধ করে দিতে হয়। ৫ সেপ্টেম্বর, শিক্ষক দিবসের দিন আবার খোলে পাঠশালা। সেই থেকে প্রতি রবিবার সৌম্যদীপ এবং তাঁর বন্ধুরা মিলে ক্লাসের ব্যবস্থা করছেন। তবে এই ক্লাস একেবারেই অন্যরকম। খাতা-কলমের মধ্যে আটকে থাকা ক্লাস নয়। বরং এর বাইরে গিয়ে জীবন গঠনের শিক্ষাই দিতে চান সৌম্যদীপরা। তিনি বলছিলেন, “আমাদের এখানে বেশিরভাগ শিশুই বাবা-মায়ের স্নেহ না পেয়ে বেড়ে ওঠে। দারিদ্র্য, অশিক্ষা পেরিয়ে যাওয়ার মতো শিক্ষা তাদের হাতে তুলে দেওয়াটাই লক্ষ্য।” দারিদ্র্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চোলাই মদের প্রকোপ। ফলে খুব কম বয়সেই মারা যান বহু পুরুষ। তাঁদের অল্প বয়সী স্ত্রীরাও হয়তো অন্য পুরুষকে বিবাহ করেন। শিশু সন্তানগুলি থেকে যায় মামার বাড়িতে, অবহেলায়, অযত্নে। জানালেন তিনি।

স্কুলে পড়া তাদের কাছে বিলাসিতা। এমনকি সরকারি-বেসরকারি স্কুলগুলিও যেন তাদের পড়াশোনার বিষয়ে বিশেষ আগ্রহী নয়। তাই সৌম্যদীপরাই সেই দায়িত্বটা তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধে। প্রতি রবিবার সাধারণ পড়াশোনার সঙ্গে চলে বিশেষ কোনো মানুষের জীবন নিয়ে আলোচনা। আজকের দিনটাতে তেমনই বেছে নেওয়া হয়েছিল সদ্য পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত তুলসী গৌড়ার কাহিনি। “ওরা পদ্মশ্রী পুরস্কারের অর্থ বোঝে না। কিন্তু তুলসী গৌড়ার প্রকৃতি বাঁচানোর লড়াই ওদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।” বলছিলেন সৌম্যদীপ। চারাগাছ রোপণের শেষে প্রতিটা গাছের নামও দেওয়া হয়েছে শিশুদের নামে। গাছের সঙ্গে এভাবেই আত্মীয়তার বন্ধন গড়ে উঠল শিশুদের। “এর আগে গাছ লাগানোর উদ্যোগ নিলে হয়তো সেগুলোও কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন এই গাছেরা শিশুদের কাছে মানুষের চেয়েও বেশি। এদের কেটে ফেলা সহজ হবে না।” এই বিশ্বাসটাই সাহস জোগাচ্ছে সৌম্যদীপদের। এভাবেই নতুন প্রজন্মের হাত ধরে একটা সবুজ ভবিষ্যত গড়ে উঠবে নিশ্চই।

Powered by Froala Editor