সুন্দরবনের গ্রামে নয়া বইঘর, দিনবদলের স্বপ্নে বুঁদ খুদেরাও

সুন্দরবন অঞ্চলের পিয়ালী স্টেশন থেকে কিছুটা দূর এগোতেই চারদিকের দৃশ্যপট বদলে যাচ্ছিল। চারিদিকে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। তার মধ্যেই জায়গায় জায়গায় মানুষের বাস। ছোটো ছোটো ঝুপড়ি অথবা কুঁড়ে ঘর, দু-একটা পাকা বাড়িরও দেখা মেলে। তবে সেইসব বাড়ির গায়েও প্লাস্টার পড়েনি, ঘরের ছাদ অ্যাসবেস্টজের। সুন্দরবন থেকে জীবিকার সন্ধানে চলে আসা মানুষদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই নতুন জনপদ। পোশাকি ভাষায় যাঁদের বলা হয় ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’। এইসব পরিবারের পুরুষরা প্রায় সকলেই দিনমজুর। মহিলারা রোজ কলকাতায় যান, নানা বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। অথচ এই জীবনের মধ্যেই এক নতুন স্বপ্ন বুনছে সেখানকার কচিকাঁচারা।

গ্রামের মধ্যেই একটি বাড়ির চিলেকোঠার ছাদে তারা তৈরি করে ফেলেছে আস্ত একটি লাইব্রেরি। একটা নামও দিয়েছে তারা – ‘পিয়ালীর বইঘর’। পিয়ালীর পড়ুয়াদের এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘এবং আলাপ’। তাঁদেরই আমন্ত্রনে ২ নভেম্বর প্রহরের পক্ষ থেকে আমরা উপস্থিত হয়েছিলাম সেখানে। কাঁচা রাস্তায় জল জমেনি। তবে গত বর্ষার ছাপ তখনও পড়ে রয়েছে। জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ। সেইসব পেরিয়ে পৌঁছানো গেল তাপসী মণ্ডলের বাড়িতে। বছর দুয়েক আগে পিয়ালীতে এসেছেন তাপসীদি। এর আগে, ২০০৯ সাল থেকে তিনি ‘এবং আলাপ’-এর সঙ্গে কাজ করেছেন সুন্দরবনের বালি অঞ্চলে। পিয়ালীতে আর যাঁরা আছেন, তাঁরাও সুন্দরবনেরই মানুষ। কোনো বিশেষ কাজ নিয়ে আসেননি তাপসীদি। তবে গ্রামের পরিস্থিতিই তাঁকে নতুন করে দায়িত্ব নিতে বাধ্য করল। লকডাউনের শুরুতেই একদিন তিনি শুনলেন, গ্রামের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ের বন্দোবস্ত করেছে পরিবার। পাত্রের বয়স অন্তত ২০ বছর বেশি। মেয়েটি বিয়ে করতে একেবারেই রাজি নয়।

সেদিন চুপ করে থাকতে পারেননি তাপসীদি। সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলেন সমস্যার মূল আরও গভীরে। লকডাউনে কাজ হারিয়েছেন গ্রামের প্রায় সকলেই। সামান্য খাওয়া-পরার সামর্থ্যটুকুও আর নেই। এই পরিস্থিতিতে পরিবারের বোঝা কমাতেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন অনেক বাবা-মা। ‘এবং আলাপ’-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে তাপসীদি সেই মুহূর্তে কিছু রেশনের ব্যবস্থা করে দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু শুধু রেশন পেলেই তো হবে না, ছেলেমেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা যে ভীষণ প্রয়োজন। এরপর তাঁর বাড়িতেই মাঝে মাঝে পড়ুয়াদের নিয়ে আড্ডা বসতে শুরু করল। তারপর নিয়মিতভাবে শুরু হল কর্মশালা। স্থানীয় এক অভিভাবক বলছিলেন, “আমি প্রথমে মেয়েকে এখানে পাঠাতে চাইনি। কিন্তু নিজের কৌতুহলেই একদিন এসে দেখলাম। তারপর থেকে মেয়েকে প্রত্যেকটা ওয়ার্কশপে পাঠিয়েছি।”

পিয়ালীর বইঘর এবং তাপসী মণ্ডল
পড়াশোনা তো চলতই। সেইসঙ্গে নিজেকে নিজের মতো করে আবিষ্কার করতেও শিখছিল তারা। মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যাওয়া বা নারী নির্যাতনের মতো ঘটনায় অভ্যস্তই হয়ে উঠেছিল সকলে। কিন্তু অন্যভাবেও যে বাঁচা সম্ভব, সেটাই যেন শেখাচ্ছিলেন তাপসীদি। তিনি বলছিলেন, “গ্রামের অনেক ছেলে মাঠে ফুটবল ক্রিকেট খেলতে যেত না। কিন্তু তারা কেউ সুন্দর নাচ করত, কেউ ছবি আঁকত। ঠিক বাকি ছেলেদের মতো নয় বলে তাদের ‘লেডিস’ বলে ডাকত সবাই। কিন্তু তারা যা ভালোবাসে, তাই নিয়েই কেন এগিয়ে যেতে পারবে না?” তাপসীদির বাড়িতে তাই নাচ-গান থেকে শুরু করে আবৃত্তি, ছবি আঁকা – নানা বিষয়ের কর্মশালার আয়োজন করা হত। এমনকি পড়ুয়াদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অভিভাবকরাও আসতেন এইসব কর্মশালায়।
বইঘরে বসে ছবি আঁকায় ব্যস্ত পড়ুয়ারা

গত স্বাধীনতা দিবসে নেওয়া হয়েছিল এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ। পিয়ালীর পড়ুয়ারা নিজেরাই একটা শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের ভিতর দিয়ে সেদিন তারা চিনছিল নিজেদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে। এই সমস্ত প্রতিকূলতাকে পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নকে। ঠিক এই সময়েই দানা বাঁধছিল আরেকটি উদ্যোগও। এক কর্মশালায় হঠাৎ কথা হয়, পড়ুয়াদের জন্য একটি লাইব্রেরি প্রয়োজন। একজন ছাত্রী বলছিল, “আমাদের যা আর্থিক অবস্থা, তাতে পাঠ্যবই কিনতেই পারি না আমরা। আরও যে নানা ধরনের বই পড়ব, কিন্তু সেসব পাব কোথায়?” ঠিক হল, লাইব্রেরি তৈরি হবে। আর তার দায়িত্ব নেবে এই ছাত্রছাত্রীরাই। কিন্তু লাইব্রেরি মানে তো শুধুই বইয়ের ভাণ্ডার নয়। তাকে ঠিকভাবে পরিচালনাও করতে হবে। তার ব্যবস্থাও হল। পুজোর ঠিক আগেই একদিন কলকাতার গ্রন্থাগারিক রাজীব কুণ্ডু পৌঁছে গেলেন পিয়ালীতে। সেখানে সারাদিনের কর্মশালায় শেখালেন, কীভাবে সমস্ত বইয়ের হিসাব রাখতে হয়। কীভাবে বইয়ের যত্ন নিতে হয়।

 ‘এবং আলাপ’-এর পক্ষ থেকে একদিন বেশ কিছু বই নিয়ে পৌঁছে যাওয়া হল সেখানে। নতুন বই পেয়ে রীতিমতো খুশি সকলেই। সেই থেকে চলছে ‘পিয়ালীর বইঘর’-কে সাজিয়ে তোলার কাজ। নানা ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে কচিকাঁচাদের। এই লাইব্রেরিতে তারা নিয়মিত একসঙ্গে বসে পড়াশোনা থেকে শুরু করে পাঠচক্রের আয়োজন করারও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, বইয়ের পাতা থেকে নানা বিষয়কে তুলে এনে সেগুলো নিজেদের মতো করে ছবিতে, নাটকে উপস্থাপন করতে চায়, এমনটাও জানাল অনেকে। এর মধ্যেই কেউ কেউ বসে পড়েছে খাতা-পেনসিল নিয়ে। কোনো গল্পের দৃশ্যকে নিজের মতো করে ফুটিয়ে তুলছে সাদা পাতায়। কেউ আবার মিনিয়েচার দুর্গামূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত।

 

গানের আয়োজন

ছোটো ছোটো পড়ুয়াদের এই আয়োজন দেখতে দেখতেই সন্ধে নেমে এল। ফিরতি পথে পা বাড়ানোর সময়ে কানে আসে, তারা একসঙ্গে গান ধরেছে। ‘ভারত আমার ভারতবর্ষ’। আজও এক স্বপ্নের স্বদেশ রচনার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তাদের এই স্বপ্নের পাশে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। ‘পিয়ালীর বইঘর’-এর জন্য আর্থিক সাহায্য হোক, বা পুরনো-নতুন বই – যে যেভাবে পারছেন সাহায্য করছেন। এমন একটা উদ্যোগকে টেনে নিয়ে যাওয়াও খুব সহজ কাজ নয়। তাপসীদির চোখেমুখেও সেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তবে এখনও তিনি মুখে সাহসের হাসি টেনে বলতে পারেন, “টাকার জন্য এই কাজ আটকে যাবে না।”

ছবি - শুভদীপ কুণ্ডু

 

Powered by Froala Editor

Latest News See More