ছিলেন পারস্যের শাহ, হয়ে গেলেন পীর বহরম সক্কা। তাঁর কথা পারস্যের কোনো শাহী পরিবারের ইতিহাসে আরও একজন শাহ হিসেবেও শোনা যেতে পারত। কিন্তু পীর বহরম সক্কার নেকী-র কথা বেঁচে রইল এই হিন্দুস্তানে। তাঁর মাজারে আজও মানুষ মাথা ঠেকায়, চাদর চড়িয়ে, ধূপ-দীপ দিয়ে তাঁকে স্মরণ করে। মানুষের জীবন, তার ভবিতব্য কেমন বিচিত্র! তাই না?
শাহ ওয়ার্দি বায়াৎ (মতান্তরে বায়েৎ) পারস্যের তাবরেজ অঞ্চলে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে জন্মগ্রহণ করেন। শাসক পরিবারের সদস্য না হ'লে পারস্যে 'শাহ' শব্দ নামে ব্যবহার হয় না। আর 'বায়াৎ' অথবা 'বায়েৎ' হ'ল একটি তুর্কী সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর নাম – যারা তুর্কী, পারস্য এবং আজারবাইজানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সময়ের সঙ্গে ছড়িয়ে যায়। চেঙ্গিসের মোঙ্গল সৈন্য যখন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে অগ্রসর হয়, তখন বায়াৎ জনজাতি প্রবল পরাক্রমে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। সম্ভবত কুখ্যাত নাদির শাহ-ও এই বায়াৎ গোষ্ঠীরই একজন ছিলেন, যাঁর হিন্দুস্তান আক্রমণের সময় বায়াৎরা আফগানিস্তান অবধি ছড়িয়ে পড়ে।
পীর বরহম দিল্লি ত্যাগ করেন এবং চলতে চলতে একসময় উপস্থিত হন বাংলায়।
যৌবনে, পারস্যের তিনটি এলাকা জুড়ে অনেকটারই শাসনভার ছিল শাহ ওয়ার্দি বায়াতের ওপর। বলা যায়, শাসকের অধীনে গভর্নর (নাজিম-এর মতো) হিসেবে তিনি এই রাজ্যগুলি পরিচালনা করতেন। শের শাহের কাছে পরাজিত হয়ে সর্বহারা হুমায়ূন যখন হিন্দুস্তান থেকে কিছু ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে পারস্যের পথে পালিয়ে গেছিলেন তখন এই শাহ ওয়ার্দি বায়াত-ই তাঁকে আশ্রয় দেন। মর্যাদার সঙ্গে অতিথি সৎকার করেন।
শাহ ওয়ার্দি বায়াতের ঈশ্বর চিন্তা এবং মানব-সেবার ইচ্ছা তাঁকে শাসক থেকে সাধকে পরিণত করে ধীরে ধীরে। তিনি মক্কা-মদিনা যাত্রা করেন এবং হাজী হয়ে ফিরে আসেন। হয়ে ওঠেন সুফী কবি। হাজী বায়াতের মানব সেবার একটি পন্থা ছিল পথচারীদের পিপাসার জল খাওয়ানো। পিপাসার জল বয়ে নিয়ে যেতেন বলেই ওনার নাম হয়ে গেল 'বহরম সক্কা'; 'সক্কা' –> যে জল দেয়; বহরম সক্কা –> পিপাসার জল বয়ে নিয়ে আসা মানুষ। পারস্যের শাহ ওয়ার্দি, হয়ে গেলেন পীর বহরম সক্কা। মক্কা আর নাজাফের পথে ক্লান্ত পথিক, হজ যাত্রী – এদের সেবা করতেন, তৃষিতের জন্য জল, বিশ্রামের ব্যবস্থা করতেন। তারপর একসময়, ঘটনাচক্রে চলে এলেন হিন্দুস্তানে। যে হুমায়ূনকে একদিন তিনি দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন; তাঁরই পুত্র সম্রাট আকবর বহরম সক্কাকে নিজের অতিথি এবং উপদেষ্টা হিসেবে কাছে পেতে চেয়েছিলেন। দিল্লি এবং আগ্রার পথে পীর বহরমকে দেখা যেত পথচারীদের সেবা করতে, পিপাসার জল এগিয়ে দিতে ক্লান্ত পথিকদের দিকে।
এখানেই সমাধিস্থ করা হয় শের আফগান এবং নবাব কুতুবুদ্দিন কোকা-কে
ক্রমে, যা হয়... আকবরকে পীর বরহমের সুফিয়ানা দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে, ভিন্নমত পোষণকারী আবুল ফয়জল, ফৈজী প্রমুখ ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ওঠে। রাজদরবারের আভ্যন্তরীণ কূটনীতি আর ষড়যন্ত্রে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পীর বরহম দিল্লি ত্যাগ করেন এবং চলতে চলতে একসময় উপস্থিত হন বাংলায়। অধুনা বর্ধমানের এক অঞ্চলে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বিশ্রাম নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো কোনো সূত্রে বলা হয়, বাংলায় পৌঁছোনোর তিন দিনের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু এই তথ্যর প্রতি নিঃসংশয় থাকা যায় না। কারণ, এই বর্ধমানেই জয়পাল নামক এক হিন্দু প্রভাবশালী ব্যক্তি এই পীরের দর্শন, কথা, (বলা হয়ে মোজেজা বা অলৌকিক কিছু দেখানো) ইত্যাদিতে প্রভাবিত হয়ে পীরের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পীরের সেবায় উৎসর্গ করেন নিজের পার্থিব সর্বস্ব; এবং অবশিষ্ট জীবন পীর বহরমের মাজার সংলগ্ন বাগানের এক কোণে একটি কুটিরে যাপন করেন – পীরের দেখানো পথে মানুষের সেবার মধ্যে দিয়ে আল্লাহ্-র সেবা করে। কেবল তিনদিনে কি এত বড় প্রভাব বিস্তার সম্ভব যাতে এত বছর পরেও পীর বহরমের নাম ওই অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে ফেরে? একটা বিদ্যালয় পর্যন্ত তাঁর নামে হয়?
যাই হোক, আনুমানিক ১৫৬৩-১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দেই কোনো এক সময় পীর বহরমের জীবনাবসান হয় এই বর্ধমানেই। বলা হয়, পীর বহরমের ইন্তেকালের পর আকবরের নির্দেশে, বাদশাহী খরচেই পীর বহরমের মাজার প্রতিষ্ঠা হয়, মাজারে চড়ানো হয় সোনা দিয়ে অলংকৃত রেশমের চাদর। সেই অঞ্চল থেকে পাওয়া বাদশাহী করের কিছুটা মাসিক দান করা হত এই মাজারে, দরিদ্র সেবার জন্য। দৈনিক দু'টাকা ব্যয় হত দরিদ্র সেবায়। সেই সময় দৈনিক দু’টাকা খরচ মানে অনেক।
বর্তমানে, বর্ধমান স্টেশন থেকে খানিক দূরে বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দির, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, বর্ধমান রাজ কলেজিয়েট স্কুল... এই তিনটের যে-কোনো একটিকে ল্যান্ডমার্ক ধরেই মোটামুটি এক কিলোমিটারের দূরত্বে পীর বহরম সিক্কার এই মাজারে পৌঁছনো সম্ভব। এমনকি ওই মাজারের কাছাকাছি একটি প্রাইমারি স্কুলও আছে – পীর বহরম প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়। বিশেষ করে অঞ্চলটিকে চিহ্নিত করতে আলমগঞ্জ বললেই হবে। অবশ্য, পীর বহরমের মাজার বললেও চিনিয়ে দেবে স্থানীয় মানুষ।
এই পীর বহরমের মাজারের আরও একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে বাংলা এবং ভারতের ইতিহাসে। এখানেই সমাধিস্থ করা হয় শের আফগান এবং নবাব কুতুবুদ্দিন কোকা-কে। সেই শের আফগান, যাঁর পত্নী মেহেরুন্নিসা পরবর্তীকালে হয়েছিলেন নূর জাহান – মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের বেগম।
শেষে আবার কিছু নতুন প্রশ্ন মনে আসে -
- এই জয়পাল ব্যক্তিটি কে? পীর বহরমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করার আগে বা পরে কী করতেন? কেবল এই একজনই কি পীরের অনুগত হয়েছিলেন ওই অঞ্চলে?
- পীর বহরমের মাজারের কাছেই আরও একটি মাজার আছে - দাতা বাবা মাজার। হাজি ফরহৎ শাহ নামক এক পীরকে বলা হত 'দাতাবাবা'। কে এই হাজি ফরহৎ শাহ? ওঁর সঙ্গে কি পীর বহরমের বা ওনার পরবর্তী কারও যোগ আছে? জয়পালই পরে ফরহৎ শাহ হয়ে যাননি তো?
জানেন কেউ?