পৃথিবীর ৭টি দেশ থেকে এসেছেন বেশ কয়েকজন মহিলা ক্রীড়াবিদ। অবশ্য তাঁদের ক্রীড়াবিদ বলা হবে কিনা, এই নিয়ে তখনও তর্ক চলছে। কারণ খেলার অভিজ্ঞতা থাকলেও প্রথাগত প্রশিক্ষণ পাননি প্রায় কেউই। অথচ পা রাখতে চলেছেন আন্তর্জাতিক স্তরের এক প্রতিযোগিতায়। প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে ফ্রান্সের সীমান্ত পেরিয়ে মোনাকো সমুদ্র উপকূলে মন্টে-কার্লো শহরে। তবে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মতো কোনো স্টেডিয়াম বা ট্রাক পাওয়া গেল না। কারণ প্রতিযোগীরা সকলেই মহিলা। মহিলাদের জন্য কিছু হালকা খেলা অবশ্য অলিম্পিকেই চালু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দৌড়, রেসলিং, লং জাম্প, হাই জাম্পের মতো শারীরিক কসরতের খেলা কি মহিলারা দেখাতে পারেন? আয়োজকদের নিয়ে শুরু হল হাসাহাসি।
প্রতিযোগিতা অবশ্য নির্দিষ্ট সূচি মেনেই হল। ট্রাক পাওয়া না গেলেও পাওয়া গিয়েছিল একটি পাখি শিকারের রেঞ্জ। মন্টে-কার্লো শহর সাক্ষী থাকল মহিলাদের প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। আর এই বিরাট আয়োজনের পিছনে ছিল যে মানুষটির নিরলস পরিশ্রম, তাঁর নাম অ্যালিস মিলিয়েট। ফ্রান্সের খ্যাতনামা লেখিকা ও অনুবাদক মিলিয়েট। তবে খেলাধুলোর প্রতি তাঁর অনুরাগ ছোটো থেকেই। আর তখন থেকেই দেখেছেন, শুধুমাত্র লিঙ্গ পরিচয়ের কারণে প্রতিযোগিতার আসর থেকে কীভাবে ছিটকে যান মহিলারা। মিলিয়েট এই ব্যবস্থায় বদল চেয়েছিলেন। অবশ্য অলিম্পিকে মহিলাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্যারন পিয়ের কুবারটিনও বেশ উৎসাহী ছিলেন। ১৯০০ সালেই তাঁর উদ্যোগে শুরু হয়েছিল অলিম্পিকের মহিলা প্রতিযোগিতা। কিন্তু ওই যে, সামান্য কিছু হালকা খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যা নিছকই শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের বিনোদনের মাধ্যম।
১৯১৯ সালে প্রথম অলিম্পিক কমিটির কাছে আবেদন জানালেন মিলিয়েট। ততদিনে স্থির হয়ে গিয়েছে, ১৯২৪ সালে অলিম্পিকের আয়োজন হতে চলেছে প্যারিস শহরেই। তাঁর নিজের দেশের মাটিতেই ঘটুক এই বিপ্লব, চেয়েছিলেন মিলিয়েট। কিন্তু প্রস্তাব রাখা মাত্র তা বাতিল করল অলিম্পিক কমিটি। মিলিয়েট হাল ছাড়লেন না। একাই এক আলাদা প্রতিযোগিতার আয়োজন শুরু করলেন। সমমনস্ক আরও কয়েকজন মহিলাকে নিয়ে গড়ে তুললেন ‘ফেডারেশন স্পোর্টিভ ফেমিনিন ইন্টারন্যাশানালি’। আর এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই ১৯২১ সালে আয়োজিত হল পূর্বোক্ত প্রতিযোগিতা। প্রথমবারের সাফল্যে আত্মবিশ্বাস পেলেন মিলিয়েট। এবার প্রত্যক্ষ লড়াই অলিম্পিক কমিটির সঙ্গে।
১৯২২ সাল। আবারও আয়োজিত হল এই প্রতিযোগিতা। এবার মিলিয়েট তার নাম রাখলেন ‘উইমেন্স অলিম্পিক গেমস’। আর সমস্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন হল প্যারিসের পার্সিং স্টেডিয়ামে। এবারে অবশ্য প্রতিযোগিতায় অংশ নিল ৫টি দেশ। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, সুইৎজারল্যান্ড, চেকস্লোভাকিয়া এবং ফ্রান্স। ১১ জন প্রতিযোগীর খেলা দেখতে ভিড় করলেন ২০ হাজার মানুষ। অলিম্পিক বলে কথা, তাও আবার মহিলাদের! আয়োজন ব্যর্থ হলে হয়তো অলিম্পিক কমিটি এইসব নিয়ে মাথা ঘামাত না। কিন্তু মিলিয়েটের সাফল্য তাঁদের আতঙ্কিত করল। সঙ্গে সঙ্গে আইনি নোটিশ পাঠালেন মিলিয়েটকে। অলিম্পিকের নাম ব্যবহার করা যাবে না কোনোভাবেই। তার বদলে আরও কয়েকটা খেলায় মহিলাদের অংশগ্রহণের কথা ভাবতে পারে অলিম্পিক কমিটি।
আরও পড়ুন
‘হ্যাঁ, আমি সমকামী’, অলিম্পিকে সোনা জিতে গর্বিত উচ্চারণ টমের
মিলিয়েট কিন্তু চেয়েছিলেন, বাছা বাছা কয়েকটি নয়, বরং অলিম্পিকের সমস্ত খেলাতেই অংশ নিক মহিলারা। তাই অলিম্পিক কমিটির প্রস্তাবে রাজি হতে চাননি কিছুতেই। কিন্তু আইনি জটিলতা মেটাতে এফএসএফআই-এর অন্যান্য সদস্যদের মত মেনে নিয়েই নাম পাল্টাতে রাজি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ঠিক করলেন, এবার অলিম্পিকের সমস্ত নিয়ম মেনেই হবে আয়োজন। যথারীতি অলিম্পিকের মতোই ৪ বছর পর ১৯২৬ সালে স্থির হল পরবর্তী প্রতিযোগিতার সময়। এবারে নাম ‘উইমেন্স ওয়ার্ল্ড গেমস’। আর আয়োজক শহর সুইডেনের গথেনবার্গ। এরপর ১৯৩০ সালে প্রাগ শহর এবং ১৯৩৪ সালে লন্ডন শহরে হল প্রতিযোগিতা। ক্রমশ জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকল মহিলাদের ক্রীড়া প্রতিযোগিতার। কিন্তু প্রতিবন্ধকতা পিছু ছাড়ল না।
আরও পড়ুন
বাংলা-সহ ৩০টি ভাষায় ইমোজি প্রকাশ অলিম্পিক কমিটির
মিলিয়েটের সঙ্গে যে ক্রীড়া সংস্থারাই এগিয়ে আসেন, তাঁদেরই বাদ পড়তে হয় অলিম্পিকের আয়োজন থেকে। কিন্তু শুধুমাত্র মহিলাদের খেলাধুলোয় উৎসাহ দিতে অলিম্পিক থেকে ছিটকে যেতে চান না কেউই। অবশ্য এসবের মধ্যেও নানা দেশে মহিলাদের নিজস্ব ক্লাব গড়ে উঠছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল অর্থ। আন্তর্জাতিক স্তরের একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করতে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। এদিকে কোনো ধনী ব্যক্তিই এগিয়ে আসতে চাইছেন না। এদিকে ১৯৩৬ সালে মিলিয়েটের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব দিল অলিম্পিক কমিটি। তাঁরা ভেবে দেখতে চান আর কোন কোন প্রতিযোগিতায় মহিলাদের অংশগ্রহণ সম্ভব। আলোচনার প্রস্তাবেই বোঝা যায়, সমস্ত প্রতিযোগিতায় কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
অলিম্পিকের আগেই কুস্তির বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ৮টি সোনা ভারতের
মিলিয়েট হয়তো এই আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়েই দিতেন। কিন্তু এর মধ্যেই ফ্রান্স সরকার জানিয়ে দিয়েছে, উইমেন্স ওয়ার্ল্ড গেমসে তাঁরা যে অর্থসাহায্য করতেন, তা আর করা হবে না। এরপর আর উপায় থাকে না। প্রতিযোগিতা বন্ধ হবেই। অতএব অলিম্পিক কমিটির প্রস্তাবে সাড়া দিতে হল তাঁকে। সেটা ১৯৩৬ সাল। আর তারপর কেটে গিয়েছে ৮৫ বছর। অলিম্পিকের বর্তমান পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখতে পাব, ৪৬ শতাংশ খেলায় পুরুষদের পাশাপাশি মহিলারাও অংশগ্রহণ করেন। আর মোট প্রতিযোগীদের মধ্যেও মহিলাদের সংখ্যা থাকে ওই ৪০ শতাংশের আশেপাশে। ক্রমশ মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু তবুও সাম্যে পৌঁছয়নি। ১০০ বছর আগে মিলিয়েট যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, আজও তা স্বপ্নই। আর সেই স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন সারা পৃথিবীর অসংখ্য মহিলা খেলোয়াড়।
Powered by Froala Editor