সত্তরের দশক। লখনৌ স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে এক আশ্চর্য দৃশ্য চোখে পড়েছিল তাঁর। স্টেশনের পাশে ছোট্ট একফালি জমিতে ক্রিকেট খেলছে একদল কিশোরী। প্লাস্টিকের বল, জীর্ণ ব্যাট, ইটের উইকেট। সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুতের মতো খেলে গিয়েছিল ভাবনাটা। ক্রিকেট কি শুধুই পুরুষদের খেলা? ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেশের মেয়ে যদি ক্রিকেট খেলতে পারে, তবে ভারতীয়রাই বা কেন পিছিয়ে থাকবে এক্ষেত্রে? তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হলে, একদিন দেশের নাম উজ্জ্বল করবে এই কিশোরীরাও।
হ্যাঁ, অপটু গলি-ক্রিকেট খেলা, ভারতীয় কিশোরীদের এক ছাতার তলায় আনতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁদের নিয়েই আন্তর্জাতিক দল তৈরি করে দেখিয়েছিলেন, কোনো অংশ কম যায় না ভারতীয়রাও। মহেন্দ্র কুমার শর্মা (Mahendra Kumar Sharma)। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের পথিকৃৎ তিনিই। দীর্ঘ লড়াই-এর পর গত মঙ্গলবার ৭৫ বছর বয়সে ‘অবসর’ নিলেন ভারতের অন্যতম ক্রিকেট-কিংবদন্তি। পাড়ি দিলেন চিরঘুমের দেশে। ২০২০ সালে কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকেই শ্বাস-জনিত সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি। সঙ্গে থাবা বসিয়েছিল ডিমেনশিয়া। বিগত এক বছরেরও বেশি সময় হাসপাতালে লড়াই চালানোর পর, শেষ পর্যন্ত হার মানলেন মহিলা ক্রিকেটের পথিকৃৎ।
লখনৌ-এর নিউ হায়দ্রাবাদ অঞ্চলে জন্ম ও বেড়ে ওঠা মহেন্দ্র কুমারের। ছোটো থেকেই ক্রিকেট নিয়ে আকাশছোঁয়া আগ্রহ ছিল। তবে পেশাদার ক্রিকেটার হিসাবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা হয়ে ওঠেনি কোনোদিনই। তবে, মহিলা ক্রিকেটকে জনপ্রিয়তা দানের নেপথ্যে তাঁর অবদান এককথায় অনস্বীকার্য।
ভারতীয় ক্রিকেট বললেই, একবাক্যে উচ্চারিত হয় বিসিসিআই-এর নাম। তবে মজার বিষয় হল, আন্তর্জাতিক মহিলা ক্রিকেট দল তৈরিই হোক কিংবা মহিলাদের জন্য পৃথক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন— কোনোটিতেই সেভাবে আগ্রহ দেখায়নি বিসিসিআই। বরং, সেই দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন খোদ মহেন্দ্র কুমার। ১৯৭১ সালে লখনৌ-এর বুকে তিনি প্রথমবারের জন্য আয়োজন করেছিলেন মহিলাদের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।
‘কন্যাও কি ক্রিকেট হোগি, জরুর আইয়েগা’— গম গম করে উঠেছিল লখনৌ-এর রাস্তা। হ্যাঁ, মাঠ উপচে উঠেছিল দর্শকের ভিড়ে। তবে তা সত্ত্বেও তাঁর এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগকে সেভাবে স্বাগত জানায়নি বিসিসিআই। মহিলাদের ক্রিকেট আয়োজন করার জন্য, তীর্যক শব্দবাণেও বিদ্ধ হতে হয়েছিল বহু মানুষের কাছেই। তবে হাল ছাড়েননি তিনি।
এই টুর্নামেন্টের পরই ব্যক্তিগত উদ্যোগে মহিলাদের ক্রিকেট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন তিনি। শুরু হয় সফট বল অর্থাৎ টেনিস বলে ক্রিকেট শেখানোর রেওয়াজ। তার বছর দুয়েকের মধ্যেই তৈরি করে ফেলেন আস্ত একটি জাতীয় সংস্থা। উওমেনস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (Women's Cricket Association Of India)। শুধু উত্তর প্রদেশই নয়, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তরুণ মহিলা ক্রিকেটারদের তুলে আনাই ছিল যার অন্যতম লক্ষ্য।
অবশ্য আন্তর্জাতিক স্তরের দল তৈরির এই লড়াই খুব কিছু সহজ ছিল না। প্রাথমিকভাবে ৭ জন ক্রিকেটারকে নিয়েই তৈরি হয়েছিল ভারতের প্রথম মহিলা দল। পরবর্তীতে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ জনে। তা নিয়েই অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে মাঠে নামার সাহস দেখিয়েছিলেন তিনি। মুম্বাই-তে আয়োজন করেছিলেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচের। ভারতীয় মহিলা ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক সূচনা সেখানেই। সে-সময় ছিল না ইন্টারনেট। মহিলাদের এই খেলা দেখাতে উৎসাহী ছিল না ভারতীয় টেলিভিশন সংস্থারাও। বিভিন্ন সংবাদপত্রের দপ্তরে চিঠি দিয়ে আন্তর্জাতিক এই ম্যাচের খবর পৌঁছে দেন তিনি। পরবর্তীতে নিজ উদ্যোগে প্রকাশ করেছিলেন ছোট্ট এক পুস্তিকাও।
এরপর কেটেছে আরও ৩২টা বছর। এশিয়া কাপ থেকে শুরু করে বিশ্বকাপ— ভারতের মহিলা দলকে অন্য মাত্রা দিয়েছেন তিনি। ২০০৬ সালে বিসিসিআই উওমেনস ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার দায়িত্ব নেওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে ভার নিজের কাঁধেই বহন করেছেন মহেন্দ্র কুমার শর্মা। সরব হয়েছেন মহিলাদের সমানাধিকারের জন্যও।
আগামী বছর থেকেই ভারতে শুরু হতে চলেছে মহিলাদের আইপিএল। তাছাড়া সম্প্রতি বিসিসিআই ঘোষণা করেছে, পুরুষদের মতো সমবেতন পাবেন মহিলা ক্রিকেটাররাও। যে দাবির জন্য দীর্ঘদিন লড়াই করেছিলেন মহেন্দ্র কুমার, অবশেষে সাফল্য পেতে চলেছে সেই আন্দোলন। অথচ, এই সুদিন দেখার সুযোগ হল না কিংবদন্তি ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের…
Powered by Froala Editor