“বিশ্বে বাস্ততন্ত্রই একমাত্র স্থায়ী অর্থনীতি।” গোটা ভারতজুড়ে অনুরণন তুলেছিল এই স্লোগান। সেটা সত্তর-আশির দশকের সময়। স্বাধীন ভারতে তখন প্লাবন আসছে নগরায়নের। কোথাও তৈরি হচ্ছে সড়কপথ, রেল স্টেশন, কারখানা; কোথাও আবার বাঁধ। আর তার জন্য কাটা পড়ছে মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন বনভূমি। ঠিক এমন একটা সময়েই, রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ‘গাছ কাটলে ঝরবে রক্ত’— এমনই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন পুঁজিবাদের দিকে। আর সারা ভারত দেখেছিল, অহিংস আন্দোলনকারীরে করাতের দাঁত থেকে গাছ রক্ষা করতে সন্তানস্নেহে জড়িয়ে নিয়েছে তাদের। চমকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব।
সুন্দরলাল বহুগুণা। ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলনের প্রবর্তক তিনি। এবার কোভিড কেড়ে নিল ভারতের ‘চিরতরুণ’ পরিবেশকর্মী তথা সমাজকর্মীকে। চলতি মাসের একদম শুরুতেই দেখা দেয় তাঁর করোনার উপসর্গ। শ্বাসকষ্ট বাড়লে গত ৮ তারিখ তাঁকে ভর্তি করা হয় ঋষিকেশ এইমস-এ। শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হওয়ায় সিপ্যাপ থেরাপিও করা হয় তাঁকে। তবে শেষ অবধি বিফলে গেল চিকিৎসকদের লড়াই। ৯৪ বছর বয়সেই ইতি টানলেন ভারতের পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ।
১৯২৭ সালে উত্তরপ্রদেশের (বর্তমান উত্তরাখণ্ড) তেহরি জেলার মারোদা গ্রামে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম সুন্দরলালের। তবে বাংলার সঙ্গেও রয়েছে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক। বলতে গেলে আদতে তাঁর পূর্বপুরুষ প্রবাসী বাঙালি। প্রায় আটশো বছর আগের কথা। বাংলা থেকেই হিমালয়ে পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর তিন পূর্বপুরুষ। দক্ষ কবিরাজ এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক হওয়ার দরুন তাঁদের ডাক পড়েছিল গাড়ওয়ালের রাজদরবারে। তাঁদের পরিচর্যাই সুস্থ করে তোলে সম্রাটকে। পরিবর্তে খুশি হয়ে আস্ত একটা গ্রাম উপহার দিয়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট। পরে সেখানের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান সুন্দরলালের পূর্বপুরুষেরা। বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হয়ে ওঠেন বহুগুণা। ২০১১ সালে কলকাতায় একটি অনুষ্ঠানে এমনটাই জানিয়েছিলেন তিনি। বহুগুণা সম্প্রদায়ের ইতিহাস এবং ডঃ রামপ্রসাদ বহুগুণার বই-ও জানায় তেমন কথাই।
১৯৩৯ সাল। ভারতে তখন অশান্ত একটা সময়। গান্ধীজির নেতৃত্বে দেশজুড়ে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল ভারত ছাড়ো আন্দোলন। সুন্দরলালের বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর। গান্ধীজির ব্যক্তিত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও লড়াইয়ে নামলেন মাতৃভূমির জন্য। বছর চারেক মধ্যে গ্রেপ্তারও হতে হল তাঁকে। বিচারের হাজতবাস। ব্রিটিশ শাসকের নির্মম অত্যাচার। তবে নুব্জ হলেন না তিনি। বরং দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিলেন গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের। এমনকি সেসময় সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণও করেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন
দুই সহস্রাধিক গাছের অভিভাবক তিনি, বার্ধক্যও দমাতে পারেনি পুরুলিয়ার দুখু মাঝি-কে
দেশস্বাধীনের পর ১৯৪৮ সালে সমাজকর্মী মীরা বেহেন ও ঠাকুর বাপের সংস্পর্শে আসেন সুন্দরলাল। তারপর শুরু হয় এক ভিন্ন অধ্যায়। রাজনীতি ছেড়ে সমাজসেবায় মনোনিবেশ করেন তিনি। দেশের প্রান্তিক অঞ্চলের মানুষেরা আদৌ সরকারি পরিষেবা পাচ্ছেন তো? কী কী সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাঁদের? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন সুন্দরলাল। নিজের চোখে দেশের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে গান্ধী-মতাদর্শী সুন্দরলাল পায়ে হেঁটে ঘুরেছিলেন ৪৭০০ কিলোমিটার পথ। অতিক্রম করেছিলেন কাশ্মীর থেকে কোহিমা। দেখলেন ভারতের প্রান্তে প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে বর্ণবিদ্বেষের বিষ। সেইসঙ্গে চলছে প্রকৃতিনিধনও।
আরও পড়ুন
নিধন রুখতে বৃক্ষ-আলিঙ্গন মহিলাদের, উত্তরাখণ্ডে ‘চিপকো আন্দোলনে’র ছায়া
রাজ্যে ফিরে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করলেন বিশেষ স্কুল। তৈরি করলেন হোস্টেলও। ব্রাহ্মণ হয়েও দলিতদের জন্য তাঁর এমন উদ্যোগ মেনে নেয়নি তাঁর বন্ধু, আত্মীয়-পরিজনও। ধেয়ে এসেছিল কঠোর সমালোচনা। তবে সংকল্পে অনড় থাকলেন তিনি। গড়ে তুললেন বর্ণ-বিরোধী আন্দোলন। মূল লক্ষ্য, হরিজনদের মন্দিরে প্রদেশাধিকার আদায়। অন্যদিকে তখন বিনোভা ভাবের অনুরোধে উত্তরপ্রদেশের সাতটি জেলায় পরিবেশ ও বৃক্ষরোপণ নিয়েও সে-সময় সমানভাবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
আরও পড়ুন
১৫৫টি গাছের ঔষধি গুণ নখদর্পণে, বিনামূল্যেই চিকিৎসা করেন অশীতিপর ভাষাসৈনিক
এর বছর দশেক পরে শুরু হয় ঐতিহাসিক চিপকো আন্দোলন। ১৯৭২ সাল সেটা। উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে জলাধার তৈরির প্রকল্প নিয়েছিল সরকার। আর তার জন্য কাটা পড়ত প্রায় কয়েক হাজার বৃক্ষ। গ্রামবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে এক অভিনব প্রতিবাদ গড়ে তুললেন তিনি। জন্ম নিল চিপকো আন্দোলন। তাঁর স্ত্রী বিমলা বহুগুণাও ছিলেন সেই আন্দোলনের অন্যতম মুখ। গাছের প্রাণ বাঁচাতে এহেন প্রতিবাদ চমকে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। উল্লেখ্য, চিপকো আন্দোলনই ভারতের সর্বপ্রথম কোনো পরিবেশ আন্দোলন যেখানে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন মহিলারা।
আশি-নব্বইয়ের দশক পর্যন্তও সেই আন্দোলনের রেশ দেখা গেছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত। বিক্ষিপ্তভাবে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে বহু জায়গায় চিপকোর পথে হেঁটেছিলেন বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। সাড়া পড়ে গিয়েছিল জাতিসংঘেও। জাতিসংঘের উদ্যোগেই চিপকোতে সামিল হয়েছিল গোটা বিশ্বের ১০৮টি দেশ।
তবে চিরকালই প্রচারবিমুখ থাকতেই পছন্দ করেছেন তিনি। চেয়েছিলেন প্রান্তিক অঞ্চলে দেশের ভূমিপুত্রদের সঙ্গেই জীবনযাপন করতে। এমনকি বিবাহের সময় শর্ত ছিল এমনটাই। গ্রাম ছেড়ে কোনোদিন শহরে যাবেন না তিনি। ১৯৮১ পদ্মবিভূষণ সম্মানও প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন সুন্দরলাল।
তবে শুধুই কি পরিবেশ? অন্যায়, অবিচার দেখলেই বার বার গর্জে উঠেছেন সুন্দরলাল বহুগুণা। হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। কিছুদিন আগেও কৃষক আন্দোলনে ঝড় তুলেছিল তাঁর মন্তব্য। কড়া ভাষাতেই তিনি প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সরকারের সিদ্ধান্তকে। তখনই কেই বা বুঝেছিল ভাইরাসের থাবায় এভাবেই নিথর হয়ে যাবেন তরতাজা মানুষটা?
তথ্যসূত্রঃ
১. Bengali Bahuguna, The Telegraph
২. The Chipko Story: How a Humble Man Mobilised Thousands to Save India’s Jungles, The Better India
৩. উইকিপিডিয়া
Powered by Froala Editor