নিজের প্রাণপ্রাচুর্যকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন পিলু

পিলু ভট্টাচার্য চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হয়নি তাঁর, তবুও গেলেন। তাঁর গানের লাইন ধার করেই বলি, 'এমন ছিল না কথা।' যাঁরা খুব কাছ থেকে চিনতেন তাঁকে, তাঁরা স্বাভাবিক কারণেই শোকবিহ্বল। কিন্তু যাঁরা তাঁকে অনেকটা জেনেছিলেন শ্রুতি-পরম্পরায়, তাঁরাও কম বেদনার্ত হননি। আসলে, পিলু ছিলেন সকলকে নিয়ে চলার মানুষ। সদ্যচেনা তরুণের কাঁধে হাত রেখে পিলু বলতে পারতেন, ‘বল, কেমন আছিস?' এভাবে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা সকলের থাকে না। পিলু কি সেলিব্রেটি ছিলেন? ধর্মতলার মোড়ে ওলার অপেক্ষায় তিনি দাঁড়িয়ে থাকলে ভিড় জমে যেত কি? উৎসাহী মানুষজন অটোগ্রাফের খাতা বাড়িয়ে দিত? না বোধহয়। কিন্ত পিলু একটা বড়ো ভরসাস্থল ছিলেন অনেকেরই। বিশেষ করে  সেইসব তরুণ-তরুণীর, যাঁরা গানবাজনাকে সঙ্গী করে লড়ছে। সম্ভাবনাময় কাউকে দেখলে পিলু হাত বাড়িয়ে দিতেন। প্রয়োগশিল্পের যৌথতায় পিলু আস্থা রাখতেন। সকলকে নিয়ে হইহই করে কাজ করতেন। পিলুর কাজ মানে স্টুডিয়োর বাইরে চটিজোড়ার সারি! বড়ো ক্যানভাসে রঙিন ছবি আঁকতে ভালবাসতেন পিলু। ফেসবুক জুড়ে তাই কাল মধ্যরাত থেকেই খ্যাতনামা শিল্পীদের শোকবার্তা যেমন দেখছি, তেমনই দেখছি অসংখ্য অখ্যাত ছেলেমেয়েদেরও, তাদের 'পিলুদা' উদার বাহুতে যারা আশ্রয় পেয়েছিল।

কেমন গান গাইতেন পিলু? রোম্যান্টিক, মিষ্টি আওয়াজ ছিল না তাঁর। আদ্যন্ত সুরে-ভরা-ও নয়। জেন ওয়াই-এর ভাষায় তাঁর গলার আওয়াজ ছিল 'হাটকে'। মূলত নিজে লিখে-সুর করে গাইতেন। বিষয়ভাবনাতেও চমক থাকত তাঁর। দারুণ পারফর্মার  ছিলেন। চোখা চোখা কথা বলে, জমজমাট পরিবেশনায় মঞ্চ মাতিয়ে রাখতেন।  সব  মিলিয়ে একটা দারুণ প্যাকেজ ছিলেন পিলু। কমেডি, প্যারডির যে ধারা যে-ক'জন রচয়িতা ও কণ্ঠশিল্পী ধরে রেখেছিলেন এ-কালেও, পিলু ছিলেন সেই অল্প কয়েকজনের মধ্যে অন্যতম।

পিলু লিখেছিলেন, ‘কুড়িখানা শুঁড়িখানা পিছু-পিছু চলে, রেখো মা গো, মদেভাতে অ্যালকোলাহলে।’ পান-সংগীতে এই বিচিত্র শব্দপ্রয়োগ করে Pun করার ক্ষমতা আমাদের অনেককেই চমকে দিয়েছিল। গলায় ছিল প্রার্থিত নাটকীয়তা। তির্যকতা ছিল তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁর গান ঠিক কী 'মুখী' তা নিয়ে পিলুর খুব চিন্তা ছিল বলে  মনে হয় না। কমিউনিকেট করতে চাইতেন, পারতেনও। লোকজ সুরের প্রতি আগ্রহ ছিল পিলুর। মূলধারার গানে সে-সুরের বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন অনেকবার। সৌগত রুদ্রর কথায় 'রাধামাধব' অ্যালবামের নাম-সংগীতটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। এফএম-এর স্বর্ণসময়ে সে-গান চারবেলা বাজত।

গভীর ভাবনা-সঞ্চারী লিরিক-ও কি গাননি পিলু? 'রাধামাধব' অ্যালবামেরই 'একটা জীবন একলা থাকা/একটা জীবন একা/একটা জীবন মাথার ওপর/জলের ছবি আঁকা' মনে পড়ছে। নিবিড়, অন্তরঙ্গ প্রেম-বিরহের গান? আছে তা-ও। ‘দুজনে হেঁটেছি কত পাশাপাশি/বুঝিনি তো পথ ছিল সমান্তরাল/হাজার লোকের ভিড়ে/তোর দু-চোখের নীড়ে/ভালবাসা একটু বিকাল/তোকে ভুলতে পারি না কেন?’ 

আরও পড়ুন
শিক্ষাব্যবস্থাকে নতুন দিশা দেখিয়ে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার মালদার শিক্ষকের

মনে আছে, একবার তারা চ্যানেলে ভোট-সংক্রান্ত কোনো একটি অনুষ্ঠানে পিলুকে সুভাষ চক্রবর্তীর মতো  সাজগোজ করে প্যারডি গাইতে দেখেছিলাম। সে-লালিকায় তাৎক্ষণিক আমোদের পেয়ালা পূর্ণ হয়েছিল।

আরও পড়ুন
নাৎসিদের বিরুদ্ধে গানই অস্ত্র ‘জলদস্যু’দের, দিতে হয়েছিল প্রাণও

রাজনৈতিক বিশ্বাসে একদা বামপন্থী পিলু কোনো বড়ো তাগিদ অনুভব করেই সম্পূর্ণ বিপরীত আদর্শে বিশ্বাসী একটি রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। জড়িয়ে পড়েছিলেন সে-দলের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। ভেবেছি, মঞ্চ খুঁজছেন পিলু; নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে নয়, নিজের কাজকে মেলে ধরবার জন্য। সর্বভারতীয় কোনো রাজনৈতিক দলের আশ্রয়ে থাকলে সেই পরিসর পাবেন বলে হয়তো ভেবেছিলেন তিনি। হয়তো-বা রাজনীতি-সচেতন পিলু স্থির করে নিয়েছিলেন, কাকে ধাক্কা দিতে গেলে কার হাত ধরতে হবে। কিন্তু এহো বাহ্য! প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পিলু অকৃত্রিম ঔদার্যে দলমতরংনির্বিশেষে মনের মানুষের কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারতেন। 

আরও পড়ুন
বিনা-চিকিৎসাতেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ঝুমুরশিল্পী গান্ধীরাম মাহাতো

খেলাধুলো ভালবাসতেন পিলু। তৈরি করেছিলেন 'ইন্ডিয়া জিতেগা'-র মতো গান; ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনাকে গান শোনানোর বিরল সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। সম্মেলক কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান, দেশাত্মবোধক গান ইত্যাদি নিয়েও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন। কাজের মধ্যে থাকতে থাকতেই তাঁর চলে যাওয়া, কার্যত। অসুস্থ ছিলেন; হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছিলেন। দু’দিন আগেই ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলেন ‘আমিই পারি মৃত্যুকে পাশে দাঁড় করিয়ে আমার স্বপ্ন সফল করতে।’ প্রত্যয়ী ছিলেন পিলু, লড়াই করে যাবেন। মাঠ ছেড়ে পালানোর মানুষ ছিলেন না। 

মধ্য-পঞ্চাশে পিলুর এই চলে যাওয়া অনেক দিক থেকেই বড়ো ক্ষতি। যৌথ প্রয়াসে কিছু গড়ে তোলার মানুষ কমে আসছে সব ক্ষেত্রেই। পিলু সংগীত বুঝতেন; সংগঠনও। অনেক কাজ করার ছিল তাঁর, সেসব অচরিতার্থ স্বপ্নকল্পনা নিয়ে একেবারে  ঘুমিয়ে পড়লেন পিলু, ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে। 

তবু আরও বহু সৃষ্টিশীল মানুষের মতোই তাঁর কাজগুলো থেকে যাবে। প্রযুক্তির আনুকূল্যে হয়তো সেগুলোর সযত্ন সংরক্ষণ অসম্ভব নয়। যে যৌথতার আদর্শে তিনি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ব্যপ্ত করে দিতে চেয়েছিলেন সাধারণ্যে, তার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারলেই পিলু ভট্টাচার্যর স্মৃতির প্রতি যথার্থ সম্মান জানানো হবে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More