মঞ্চে দূষণ, কার্বন নির্গমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন এক তরুণ। পরনে বিমানচালকের পোশাক। তাঁর বক্তৃতাতেও বার বার উঠে আসছে, বিমানের কারণে বাড়তে থাকা কার্বন ফুটপ্রিন্টের কথা। বিমান সংস্থাদের মিমিক্রি করেই কি পাইলটের পোশাক গায়ে চাপিয়েছেন তিনি?
না, বিষয়টা একেবারেই তেমনটা নয়। বছর চারেক আগেও বিমানের ককপিটের দায়িত্বে থাকতেন তিনি। এই পোশাক তাঁর নিজেরই। তবে আজ সেই ইউনিফর্মই হয়ে উঠেছে তাঁর প্রতিবাদের হাতিয়ার। টড স্মিথ (Todd Smith)। বিমানচালকের (Pilot) চাকরি ছেড়ে ‘ফুলটাইম’ পরিবেশকর্মী (Environment Activist) হিসাবে নিজেকে মেলে ধরনের ৩৩ বছর বয়সি ব্রিটিশ তরুণ।
ছোটো থেকেই টডের স্বপ্ন ছিল দেশ-বিদেশে বিমান চালিয়ে উড়ে বেড়াবেন তিনি। আর সেই স্বপ্নপূরণে রীতিমতো বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। প্রায় ১ লক্ষ ইউরো খরচ করে প্লেন চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন টড। তারপর চাকরিও জুটে যায় ‘ওয়াও এয়ার’ সংস্থায়। সেসময় মূলত দেশের মধ্যেই বিমান চালাতেন তিনি। বছর কয়েক বাদে তাঁর কাছে আরও বড়ো সুযোগ আসে পর্যটন সংস্থা ‘থমাস কুক’- থেকে। এবার আন্তর্জাতিক বিমানচালকের চাকরি। দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্ন সত্যি হয় শেষ পর্যন্ত। কিন্তু হঠাৎ এই স্বপ্নের চাকরি ছাড়লেন কেন টড?
২০১৮ সালের কথা। লাইম রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন টড। চিকিৎসকের পরামর্শেই বছর খানেকের জন্য ছুটি নিয়েছিলেন অফিস থেকে। ভেবেছিলেন, মধ্যবর্তী এই সময়টাতে ঘুরে দেখবেন গোটা পৃথিবী। এর আগে কর্মসূত্রে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরলেও, এয়ারপোর্টের বাইরের পৃথিবীটা সেভাবে দেখেননি টড। বিশ্বভ্রমণ করতে গিয়েই সেই অদেখা জগতের ছবি ভেসে ওঠে তাঁর সামনে। ধীরে ধীরে চোখ খুলে যায় তাঁর। চারিদিকে দূষণ এবং দূষণ। বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর জলবায়ুও। ছোটো হয়ে আসছে হিমবাহ। অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে সবচেয়ে বড়ো আঘাতটা আসে এরপর। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষণাপত্র পড়তে গিয়ে টড জানতে পারেন, কার্বন ফুটপ্রিন্ট বৃদ্ধির সবচেয়ে দ্রুততম কারণ বিমান পরিষেবা।
আরও পড়ুন
একক ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের নিষেধে কতটা বদলাবে পরিবেশ?
টডের কথা, নিজেকেই যেন ‘বিশ্বাসঘাতক’ মনে হয়েছিল তাঁর। তারপরই সিদ্ধান্ত নেন চাকরির ছাড়ার। অবশ্য অফিসে সে ব্যাপারে তখনই কিছু জানাননি। মহামারীর পর ‘টমাস কুক’ থেকে তাঁকে তলব করা হলে, চাকরি ছাড়ার কথা পত্রপাঠ জানিয়ে দেন তিনি।
আরও পড়ুন
কারখানার দূষণে টকটকে লাল জল, প্রতিবাদে পথে উলুবেড়িয়ার পরিবেশকর্মীরা
বর্তমানে ‘সেফ ল্যান্ডিং’ নামে একটি অলাভজনক সংস্থার কর্ণধার তিনি। বিমান পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের নানাভাবে সচেতন করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন তিনি। তাঁর দাবি একদিনে বিমান পরিষেবা বা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। তবে প্রত্যেক বিমানকর্মীই কোনো না কোনোভাবে কমিয়ে আনতে পারেন তাঁদের কার্বন ফুটপ্রিন্ট। পাশাপাশি বিমান সংস্থারাও যাতে কার্বন নিউট্রাল হওয়ার লক্ষ্যে সঠিক বিনিয়োগ করেন, সে-ব্যাপারে জনমত ও প্রতিবাদ গড়ে তোলাই তাঁর কাজ।
আরও পড়ুন
পরিবেশ সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে সবার শেষে ভারত!
রানি এলিজাবেথের প্লাটিনাম জুবিলি ছিল গতকাল। আর সেখানেই হাজির হয়েছিলেন টড। উদ্দেশ্য, তাঁর দাবি যেন পৌঁছে যায় প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে। জনা পঁচিশ পরিবেশকর্মী নিয়ে বক্তৃতা দেওয়াও শুরু করেন তিনি। তবে শেষ অবধি তাঁকে গ্রেপ্তার হতে হয় ব্রিটিশ পুলিশের হাতে। যদিও এই ঘটনা, সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছে দিয়েছে তাঁর লড়াই-এর কাহিনি, পরিবেশরক্ষার বার্তা। জয়জয়কার সংবাদমাধ্যমেও। এখন দেখার এত কিছুর পরে কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে সরকারের টনক নড়ে কিনা…
Powered by Froala Editor