খালি পা। নিজের ঠোঁট কামড়ে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ছোট্ট এক কিশোর। বয়স বড়ো জোর বছর দশেক। তার পিঠে কাপড়ের স্ট্র্যাপ দিয়ে বাঁধা রয়েছে আরও এক শিশু। যেন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। মাথা এলিয়ে পড়েছে নিচের দিকে। ছবিটা দেখলেই বেশ বোঝা যায়, শিশুটি বছর দশেকের কিশোরটির নিজের ভাই। কিন্তু কীসের জন্য অপেক্ষারত তারা?
অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার। হ্যাঁ, ছোট্ট শিশুটির ঘুম ভাঙবে না আর কোনোদিনই। নিজের ভাইয়ের সৎকার করতে তাই শ্মশানে হাজির হয়েছে কিশোরটি। তবে এই মানসিক আঘাত, প্রিয়জন হারানোর পরেও নির্বিকার কিশোরটি। বুকে পাথর চেপে রেখেও শক্ত হয়ে রয়েছে সে।
এই ছবির পিছনে লুকিয়ে থাকা গল্প খুঁজতে গেলে ফিরতে হবে সাড়ে সাত দশক। ১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস সেটা। জাপান (Japan) পরিদর্শনে গিয়েছিলেন মার্কিন চিত্র-সাংবাদিক জো ও’ডোনেল। বা, ভালো করে বলতে গেলে মার্কিন সেনাবাহিনীই তাঁকে পাঠিয়েছিল জাপান পরিদর্শনে। মার্কিন সেনার বিমান হামলা, ফায়ার বোমা এবং পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাত ঠিক কতটা কার্যকরী হয়েছে— তার নথিকরণ করাই ছিল আমেরিকার উদ্দেশ্য।
সেপ্টেম্বর থেকে শুরু করে দীর্ঘ সাত মাস জাপানে কাটিয়েছিলেন ও’ডোনেল। ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের পরিণতি। তবে ক্ষয়ক্ষতির নিদর্শনের থেকেও তাঁর চোখে বেশি করে ধরা পড়েছিল মৃত, আহত, গৃহহীন মানুষদের দুঃখ, দুর্দশার ছবি। আমেরিকার বীরত্ব নয়, বরং রাষ্ট্রের হিংস্র নেতিবাচক দিকগুলিকেই তুলে ধরেছিলেন মার্কিন ফটোগ্রাফার।
আরও পড়ুন
বিশ্বযুদ্ধের ময়দান থেকে ‘নিখোঁজ’, ৭৮ বছর পর পাওয়া গেল সৈনিকের মৃতদেহ
সেই জাপান-সফরে গিয়েই সংশ্লিষ্ট ছবিটি তুলেছিলেন জো। অকুস্থল, পারমাণবিক বোমা বিধ্বস্ত নাগাসাকি শহরের ঠিক বাইরের একটি শ্মশান। পরমাণু বোমা কতটা ঘাতক ছিল, তা ছোট্ট কিশোরটির ঝলসে যাওয়া পায়ের দিকে তাকালেই স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে সে টিকে গেলেও, প্রাণ বাঁচেনি তার ভাইয়ের। ‘ব্রাদারলি লাভ উইদআউট বাউন্ডারিস’-খ্যাত এই ছবিটির গল্পকে হৃদয়বিদারক বললেও হয়তো কম বলা হয়।
আরও পড়ুন
নাৎসিদের হাতে লুঠ হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে, নিলামে ভ্যান গঘের আঁকা সেই ছবিই
আমেরিকা তো বটেই, গোটা বিশ্বজুড়েই সাড়া ফেলেছিল ও’ডোনেলের তোলা এই ছবি। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে নিজের ঠোঁট কামড়ে রক্ত বার করে ফেলেছিল জাপানি কিশোরটি। তবে তারপরেও ভাইয়ের দেহকে এক মুহূর্তের জন্য ‘কোলছাড়া’ করেনি সে। শ্মশানকর্মীরা মৃতদেহটি মাটিতে নামিয়ে রাখতে বলায় শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিল, ‘ও খুব বেশি ভারি নয়। ও আমার ভাই।’ এইটুকুই কথা ফুটেছিল কিশোরটির ঠোঁটে। তারপর জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ভাইয়ের দেহ প্রবেশ করে যাওয়ার পর ধীরে পায়ে ফিরে গিয়েছিল সেই কিশোর।
আরও পড়ুন
চল্লিশের দশকেই আটকে টুইটারের পেজ, লাইভ সম্প্রচার চলে বিশ্বযুদ্ধের!
ছোট্ট কিশোরের এই দৃঢ়তা, মানসিক জোর দেখে রীতিমতো অবাক হয়েছিলেন জো। অবাক হয়েছিল গোটা বিশ্বও। সাত দশক পেরিয়ে এসে আজও জাপানে চেতনা এবং দৃঢ়তার প্রতীক হয়ে রয়েছে দুই ভাইয়ের এই মর্মস্পর্শী ছবি। ১৯৮৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত জাপানি চলচ্চিত্র ‘গ্রেভ অফ দ্য ফায়ারফ্লাইস’-এও যেন এই ছবির গল্পকেই অন্যভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন পরিচালক ইসাও তাকাহাতা। যে ছবি দেখলে শিউরে উঠতে হয়, একটা সময় সেই ছবিই ছিল মার্কিনি সেনাদের কাছে স্মারক-সমান। ভাবতেও অবাক লাগে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঠিক কোথায় পৌঁছে দিতে পারে মানব সভ্যতাকে…
Powered by Froala Editor