সকালবেলা তাঁদের দিন শুরু হয় গাণিতিক সমীকরণ আর বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে। সারাদিনের ঠিকানা ল্যাবরেটরি। সন্ধে গড়িয়ে সেখানে কাজ চলে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত। তবু এই বিজ্ঞানযাপনের মধ্যেই শিল্পসৃষ্টির অনন্য নজির তৈরি করলেন খড়গপুর আইআইটির গবেষকরা। তাঁদের বানানো শর্ট ফিল্ম ‘পিছুটান’ জায়গা করে নিল জয়পুর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে। পেল ‘মোবাইল শর্টফিল্ম’ বিভাগে সেরার সম্মান।
গত ১৫ থেকে ১৯ জানুয়ারি পর্যন্ত জয়পুর ফিল্ম ফেস্টিভালে দেখান হয় সিনেমা দুটি। সব মিলিয়ে ৮৫টি দেশ থেকে জমা পড়েছিল প্রায় আড়াই হাজার সিনেমা। তার মধ্যে থেকে মাত্র ২৫০টি সিনেমা প্রদর্শিত হয়েছিল জয়পুর ফেস্টিভালে। সেখানেই মোবাইল শর্টফিল্ম বিভাগে স্বীকৃতি আনে ‘পিছুটান’ সিনেমাটি। তবে একটি নয়, দুটি শর্টফিল্ম পাঠিয়েছিলেন খড়গপুর আইআইটির তরুণ গবেষকরা। ‘পিছুটান’ ছাড়া ‘অফসাইড’ নামের স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটিও দেখান হয় ফিল্ম ফেস্টিভালে।
উল্লেখ্য, সিনেমাটির পরিচালক, সিনেমাটোগ্রাফার, অভিনেতা-অভিনেত্রী, সুরকার সকলেই খড়গপুর আইআইটির পাঠ্যরত বিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়া এবং গবেষক। তবে বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্প সহাবস্থান করতে পারে না কি? বছর তিনের আগের কথা। ২০১৭ সালে ঠিক এমনটাই চ্যালেঞ্জ তুলে নিয়েছিলেন খড়গপুর আইআইটির চার গবেষক। কেউ গবেষণা করছেন রসায়নে, কেউ আবার ভূতত্ত্ববিদ্যায়। তবে সকলেরই ভালোলাগার জায়গা ছিল সিনেমা। পছন্দের এই শিল্পক্ষেত্রকে খানিকটা ‘এক্সপ্লোর’ করতেই শুরু হয়েছিল নিছক পথ চলা। জিৎ মজুমদার, সায়ন দাশগুপ্ত, অভীক ভঞ্জ, শাওন বাগ— এই চার বন্ধু মিলেই তৈরি করে ফেলেছিলেন আস্ত একটা প্রোডাকশন হাউস, ‘ফার্স্টেপ প্রোডাকশন’।
আরও পড়ুন
নির্জন লাইটহাউসে ৭ দিন ও ৬০টি সিনেমা, একমাত্র দর্শকের অপেক্ষায় গথেনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসব
তবে ‘প্রোডাকশন হাউস’ শুনলে যেমনটা মনে হয়, তেমনটা একেবারেই নয়। সম্বল বলতে মোবাইলের ক্যামেরা আর একটি ল্যাব মাইক্রোফোন। মূলধন, নিজেদের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা আর সৃষ্টি। “শুরুর দিনে আমাদের সরঞ্জাম যা ছিল, আজও তাই আছে। তবে শুরুতে সিনেমা তৈরির ব্যাপারে আমরা সেইভাবে গাইড পাইনি কারোরই। ফলে কাজে ভুল-ভ্রান্তি ছিলই। ধীরে ধীরে সিনেমা বানাতে বানাতে এখন খানিকটা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়েছে সকলেরই। পরিকল্পনা রয়েছে পরবর্তীতে এইভাবেই একটি ফিচার ফিল্ম তৈরি করার”, বলছিলেন পরিচালক শাওন বাগ।
আরও পড়ুন
অস্কারের মনোনয়নে প্রথম সিনেমাই; রক্ত দিয়ে চিঠি লিখতেন মহিলা-ভক্তরা!
আশ্চর্যের বিষয়, আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁদের তৈরি সিনেমা প্রদর্শিত হলেও এই সিনেমা শূন্য বাজেটের। ফার্স্টেপ প্রডাকশনের অভিনেতা এবং পদার্থবিদ্যার গবেষক সায়ন দাশগুপ্ত জানালেন, “প্রথম থেকে শুরু করে এই পিছুটান পর্যন্ত যা যা সিনেমা তৈরি করেছি, আমরা সবটাই ন্যূনতম খরচের মধ্যে। বাজেট থাকলেও সেটার পরিমাণ হয় সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা।”
তবে প্রত্যেকেই গবেষণার কাজে যুক্ত হওয়ায় এবং ভিন্ন ভিন্ন বিভাগে কাজ করায় তরুণ এই গবেষকদের সিনেমা তৈরিতে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধকতা সময়। কাজেই সিনেমা তৈরির জন্য বেছে নেওয়া হয় কোনো ছুটির দিন। যেদিন একসঙ্গে একত্রিত হওয়া যাবে প্রত্যেকে। মাত্র এক দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ করা হয় শুটিংয়ের কাজ। কিন্তু শুধু শুটিংয়েই কি সীমাবদ্ধ একটা চলচ্চিত্র নির্মাণের কর্মকাণ্ড? তার আগে-পরেও তো থাকে একটা লম্বা প্রক্রিয়া। গবেষণা, নিজেদের পড়াশোনা সামলেও তা কীভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা?
আরও পড়ুন
সত্যজিতের সিনেমায় সুর তুলত তাঁর বেহালা, বিস্মৃতির অতলে বেলঘরিয়ার মিহির গুপ্ত
“আমাদের কমন টাইম হল রাত্রিবেলাটা। কেউ হয়তো ফিরি ১০টায়; কেউ ১১টায়, সাড়ে ১১টায়। সিনেমার সমস্ত পরিকল্পনাই করা হয় সেই সময়টায়। ক্যানটিনেই সকলে জড়ো হয়ে আলোচনা করে নেওয়া হয় কীভাবে শট নেওয়া হবে, কী কী জিনিস লাগবে বা কাস্টিং করা হবে কাকে, এই সবকিছুই। সিনেমার এডিটিংও করা হয় রাতের বেলাতেই”, উত্তর দিলেন অভীক ভঞ্জ।
সম্প্রতি জয়পুর চলচ্চিত্র উৎসবে দেখানো ‘পিছুটান’ সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে একটি যৌনকর্মীর গল্পের ওপরে। দেহব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার পরেও এক সম্পর্কের মায়াজাল তৈরি হতে পারে, তাই ধরা দিয়েছে চলচ্চিত্রটিতে। এর আগেও ২০২০ সালের টেগোর ফিল্ম ফেস্টিভালে নির্বাচিত হয়েছিল এই চলচ্চিত্রটি। অন্যদিকে ‘অফসাইড’ চলচ্চিত্রটি দেখান হয়েছিল ২০১৯-এর কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে।
তবে মহামারীর এই আবহে থেমে নেই কাজ। বরং মানুষের জীবনের ওপর লকডাউন, মহামারীর প্রভাব নিয়েই নতুন একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরি করছেন খড়গপুরের এই গবেষকরা। শুটিংয়ের পর চলছে এডিটিংয়ের কাজ। তাছাড়াও তৈরি হয়ে আছে একটি সাইকোলজিকাল থ্রিলার। আগামী ফিল্ম ফেস্টিভালগুলিতেই হয়তো দেখা মিলবে তাদের…
Powered by Froala Editor