সন্তানের জন্য ‘দেখে আঁকো’; প্রকাশ্যে পিকাসোর ঐতিহাসিক বই

বই-এর প্রতি পাতায় বেশ কিছু ছবি। কোনোটায় রয়েছে কিশোরীকে খেলা দেখানো জোকারের প্রতিকৃতি, কোনোটায় আবার ছায়া-ঘেরা পার্কের কোনো দৃশ্য। রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী, পাখি, অ্যাক্রোব্যাট, ঘোড়া এবং ফুল ছবিও। তবে প্রতিটি ছবিই অসম্পূর্ণ। বা বলা ভালো, খুদে ড্রইং শিক্ষার্থীদের জন্যই ফাঁকা রাখা হয়েছে এই ছবিগুলির একাংশ। তবে বাজার-চলতি ড্রইং বুক-এর থেকে এই বই বেশ আলাদা। শুধু শিশু নয়, প্রতিটি ছবিই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য যে কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শিল্পানুরাগীর। প্রতিটি চিত্রেই রয়েছে অসাধারণের ছোঁয়া। 

হ্যাঁ, অসাধারণই বটে। কারণ এই ‘দেখে আঁকো’ গ্রন্থের নেপথ্যে রয়েছেন বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)। নিজের হাতেই তিনি এই গ্রন্থ তৈরি করেছিলেন তাঁর প্রথম কন্যাসন্তান মায়া রুইজ পিকাসোর জন্য। পিকাসোর মৃত্যুর প্রায় ৫০ বছর পর এবার প্রকাশ্যে এল এই ঐতিহাসিক স্কেচবুক (Sketchbook)। 

পিকাসোর নিজেরও আঁকার প্রাথমিক পাঠ পেয়েছিলেন তাঁর বাবা হোসে রুইজ-এর থেকে। পেশায় তিনি ছিলেন ফাইন আর্টসের অধ্যাপক। পরবর্তীতে পিকাসো মাদ্রিদের কিংবদন্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রিয়েল অ্যাকাডেমিয়ায় ভর্তি হলেও, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই ছেড়ে দেন ক্লাস। বলতে গেলে, বাবার থেকে পাওয়া শিক্ষাই ছিল তাঁর একমাত্র পাথেয়। পারিবারিক সেই ধারা মেনেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন নিজের মেয়ের আঁকার শিক্ষক। শুধু চিত্রশিল্পই নয়, একইসঙ্গে মায়াকে শেখাতেন অরিগ্যামিও। কাগজের এরোপ্লেন থেকে শুরু করে পাখি, ঘোড়া কিংবা বাড়ির নানান আসবাবপত্রের প্রতিকৃতি— সে-সবেরও পাঠ চলত ধাপে ধাপে। কিন্তু কোথায় লুকিয়ে ছিল এইসব দুর্মূল্য সম্পদ? কীভাবেই বা প্রকাশ্যে এল তা?

এই চমকপ্রদ আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন পিকাসোর নাতনি তথা ঐতিহাসিক, কিউরেটর এবং ডিজাইনার উইডেমেয়ার। বিগত এক দশক ধরেই পিকাসোর বিভিন্ন কাজ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। বছর দুয়েক আগে তাঁর সৌজন্যে প্রকাশ্যে এসেছিল পিকাসোর বেশ কিছু চিঠি এবং স্কেচ। এবার মায়ের ট্রাঙ্ক থেকে তিনি খুঁজে পেলেন হারানো এই নোটবুক, থুড়ি আঁকা শেখার বই। সঙ্গে আরও কিছু অরিগ্যামিও উদ্ধার করেন উইডেমেয়ার।

স্মৃতিচারণায় মায়া জানিয়েছেন, সে-সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৫-৭ বছর। অর্থাৎ, ঠিক ৮০ বছর আগে সন্তানের জন্য এই বই তৈরি করেছিলেন পিকাসো। আর সেই স্মৃতিও বেশ মধুর। তখন বিশ্বযুদ্ধের সময়। রং-এর আকাল বাজারে। অনেকসময় রং-এর অভাব মেটাতে কালি কিংবা পেনসিল দিয়েই ছবি এঁকেছেন পিকাসো। হাত লাগিয়েছিলেন ছোট্ট মায়া-ও। অবাক করার বিষয়, যুদ্ধের সময় রান্নাঘরে বসেই চলত এই আঁকা-আঁকির পর্ব। 

ভ্যান গঘ, গগ্যাঁ কিংবা ম্যাটিস-এর মতো শিল্পীরা যেখানে বেশি করে জোর দিয়েছিলেন ছবির গ্রাফিক এবং বর্ণময়তার দিকে, সেখানে চিরকালই পিকাসো মনোনিবেশ করেছেন অন্য কিছুতে। রূপকই হয়ে উঠেছে তাঁর হাতিয়ার। আঁকা শেখানোর ক্ষেত্রেও তাই প্রতিপদেই অ্যাকাডেমিক বাস্তববাদের পৃথিবীকে নস্যাৎ করেছেন তিনি। একটিমাত্র রেখা দিয়ে সম্পূর্ণ চিত্র-অঙ্কন কিংবা প্রতিকৃতির গঠনই প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর ছবিতে। আর কিছুদিনের মধ্যেই ঐতিহাসিক এই গ্রন্থটি প্রদর্শিত হবে ‘সেন্টার পম্পিদু’-এর গ্যালারিতে। সামনে থেকে এই গ্রন্থের সাক্ষী হতে পারবেন সাধারণ মানুষও…

Powered by Froala Editor