রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত: বাঙালি মেধার অনন্য উদাহরণ

বাঙালির ভাইরাস বিক্ষুব্ধ অতল মনের তলদেশ দিয়ে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের জন্মদিন চলে যাচ্ছে। বাংলার মন থেকে এই নাম হয়তো আজ বিস্মৃতপ্রায়! 

আমার মাস্টারমশাই চিন্ময় গুহ আমাকে হাত ধরে শেখাচ্ছেন— মহৎ জ্ঞান ও জ্ঞানীকে কিভাবে সম্মান করতে হয়। তাঁদের অমর সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে খুঁজে নিতে হয় আপন জীবনের দর্শন। রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত বা R.K. Dasgupta (১১ জুলাই ১৯১৫ - ৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৯) নামে এক মহাসাগর দর্শন হয়েছিল আমার স্যারের হাত ধরে।

অধিকাংশ বাঙালি এখন প্রশ্ন করেন— কে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত?

তপন রায়চৌধুরী বলতেন, যে বই এখনও সূর্যের আলো দেখেনি, রবিবাবু তাও পড়ে ফেলেছেন, কিংবা তাঁর চিন্তায় 'Scholar for all season'। 

আরও পড়ুন
২১ ঘণ্টায় গোচালা-জয়! নজির বাঙালি অধ্যাপকের

তিনি শুধুমাত্র একজন ইংরেজি, বাংলা কিংবা তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নন, বাঙালি জাতির নিজস্ব প্রজ্ঞার প্রতিনিধি। তাই খুব সরল ও অকপটে বলেন, “বাবা (নলিনাক্ষ দাশগুপ্ত) আমাকে ...ব্রাহ্মসমাজেও নিয়ে যেতেন। ওঁর একটা উদার মন ছিল, একটা 'ওয়ার্ল্ড মাইন্ড' ছিল। একদিকে যেমন বাড়িতে প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর ব্রত হত, আমার মা-জেঠি লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেন, তার পর আমাদের ডাকা হত গান করার জন্য। আমরা হরির লুটের গানটান গাইতাম। সেই গানগুলো আমার আজও মনে আছে। এবং আমার চিন্তাকে সমৃদ্ধ করেছে।" 

আরও পড়ুন
বাংলার মাটি , বাংলার জল, বেঁচে থাক বাঙালির ফুটবল

এই সাংস্কৃতিক বোধ সম্বল করেই রবিবাবু অক্সফোর্ডের ছাত্রাবস্থায় অধ্যাপক আর.সি. জেনার (স্পলডিং প্রফেসর অফ ইস্টার্ন রিলিজিয়নস অ্যান্ড এথিকস)-কে বলতে পারেন, ঈশ্বর, মূর্তি ও মানবের একটা সুন্দর সম্পর্ক বাংলার সমাজের মধ্যে রয়েছে। 

আরও পড়ুন
শতাধিক বরেণ্য বাঙালির রেখাচিত্র, নববর্ষের প্রাক্কালে ব্যতিক্রমী প্রদর্শনী কলকাতায়

‘বাঙালি কি আত্মঘাতী?’— এই মর্মে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ‘আত্মঘাতী বাঙালি’-র সমালোচনা ও বীক্ষণ আজও আমাদের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটা আয়না। সমালোচনার পরেও নীরদচন্দ্র চৌধুরীর পাণ্ডিত্যকে উদ্দেশ্য করে প্রণাম জানাতে দ্বিধা করেন না তিনি। মন কতটা উদার হলে শিক্ষক হিসেবে একজন ছাত্রকে বলা যায়, "নম্বর আর কী দেব বল, ওরকম আমি লিখতে পারি না।" তাঁর 'ঐতিহ্য ও পরম্পরা : উনিশ শতকের বাংলা বিবিধ প্রবন্ধ'-তে বাংলা ও বাঙালির অসামান্যতার পরিচয় ইউরোপীয় রেনেসাঁ-র সঙ্গে এক স্রোতে মিশে যায় পাতার পর পাতায়। 

জন মিল্টনের জীবন ও কাব্য নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের গবেষণা "Milton and His Theory of Poetry" আসলে নবজাগরণ ও বিশ্বমানববোধের একটি চিন্তা ও চর্চা। 

"Philosophy and Philosopher" পড়লে বোঝা যায়, ইউরোপ ও এশিয়ার চিন্তামানচিত্র কতখানি গভীর ও অতল। আমার কলেজের মাস্টারমশাই সৌমিক বন্দোপাধ্যায় এই বই প্রথম পড়িয়েছিলেন আমাকে। নিখিল ভারতীয় ঐতিহ্য বিশ্বমানবিকতার পর্যায়ে একটা বোধ তৈরি করে বলেই রবীন্দ্রকুমার বিশ্বাস করতেন। যেমন এই একই বিশ্বাস প্রাচ্য নিয়ে রোমাঁ রোল্যাঁরও ছিল। রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ-চর্চার মধ্যে দিয়ে তিনি প্রকাশ করেন, আধ্যাত্মিক ও মানবিক দিক কিভাবে ভারতীয় জীবন ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। এখানে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত একটি নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছেন— "বেদান্ত তো অনেক। অনেক উপনিষদ। এক-একটা উপনিষদ এক-একটা কথা বলে। ওর মধ্যে একটু inconsistency আছে। কিন্তু বিবেকানন্দ একেবারে ঋগ্বেদ থেকে আরম্ভ করে একেবারে রামকৃষ্ণ পর্যন্ত বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তার থেকে একটা বেদান্ত (সৃষ্টি) করেছিলেন, যে বেদান্ত হচ্ছে The Vedanta, বেদান্তের যে বৈচিত্র সেটা নেই। ওটাকে উনি reshape করেছেন। তিনি বলতেন, personal God-ও আছে, impersonal God-ও আছে। এটা একটা মস্ত বড় invention।" (আয়না ভাঙতে ভাঙতে/ চিন্ময় গুহ/ পৃঃ ১৮)

রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ যে পুজো করার জন্য নয়, তাঁরা দার্শনিক— এই ভাবনার কথাই রবীন্দ্রকুমারের চিন্তার মধ্যে উঠে এসেছে বার বার। 

‘সেকালের কথা’ রবিবাবুর আত্মজীবনী। এই বই পড়লে নিজের জীবনকে বিশুদ্ধ করা যায়। বাঙালির একটা সাংস্কৃতিক ইতিহাস যেন সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে আছে। 'অলীক সংলাপ' বইটি পচনশীল সমাজের গালে একটি ঠাঁটিয়ে থাপ্পড়। 'মার্কস-মুচিরাম সংবাদ', 'নিখিল বঙ্গ ভিক্ষাজীবী সম্মেলন', 'গুরু-শিষ্য সংবাদ', 'বারেক এদিক বারেক ওদিক' ইত্যাদি সংলাপগুলো সাহস করে পড়লে বুঝতে পারি , আমাদের চিন্তার দৈন্য কেন আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছে। 

অন্যদিকে, মানুষ রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের কথা জানতে পারি ওঁর প্রিয় বইবিক্রেতা, বর্তমানে গড়িয়াহাটে 'অহনায়ন' দুর্লভ গ্রন্থ বিক্রয়কেন্দ্রের প্রবীর চট্টোপাধ্যায়ের কাছে। গড়িয়াহাট ফুটপাথে একটা সময় প্রবীরবাবু বই নিয়ে বসতেন, সেখানে রবিবাবু বই কিনতে আসতেন। তারপর ১৯৯৬ সালে 'অপারেশন সানশাইন' শহরব্যাপী হকার ব্যবসায়ীদের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনে। প্রবীরবাবু বলছেন, "সেই সময় স্যার আমাকে দামি দামি বইয়ের অর্ডার দিতেন, এবং সপ্তাহে অন্তত চার দিন উনি বাড়িতে কিংবা গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের অফিসে ডেকে চেক লিখে দিয়ে বই নিতেন।" 

গ্রন্থের ভিতর নিজেকে ডুবিয়ে সমাজ থেকে নিজের মুখ ফিরিয়ে নেননি তিনি।

আমাদের মস্তিষ্ক এখন হয়তো শুষ্ক মরুভূমির বালি। তার মধ্যে কিছু মরুদ্যান এখনও বেঁচে আছে— যেখানে রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তের কথা, বইপত্র সব নিভৃতে আঁকড়ে ধরে কিছু বাঙালি আজও বসে থাকে দিন ও রাত।

Powered by Froala Editor