পৃথিবীর যে-কোনো শূন্য পরিসরই পিটার ব্রুকের নাট্য ক্যানভাস

বিশ্ব “হৃদয় আমার প্রকাশ হলো...” তাঁর মহাভারতীয় পর্দা উন্মোচনের সঙ্গে সঙ্গে। রবীন্দ্র সংগীতের আলোয় জেগে উঠছে বিশ্বমঞ্চের নট ও নটীর দল। মানব পৃথিবীর সামনে উচ্চারণ করা হবে সভ্যতার উৎকৃষ্ট সংলাপের অংশ। নির্দেশ দেবেন বিংশ শতাব্দীর নাট্যব্যাস পিটার ব্রুক। পিটার স্টিফেন পল ব্রুক (১৯২৫-২০২২) এই পৃথিবীর মঞ্চ থেকে শুধু শারীরিকভাবে বিদায় নিলেন মাত্র। কিন্তু নাট্যকর্মীদের জন্য শিক্ষা দিয়ে গেলেন, “পৃথিবীর যে-কোনো শূন্য পরিসরই থিয়েটারের ক্যানভাস।”

অক্সফোর্ডে ভাষা এবং থিয়েটার নিয়ে শিক্ষা জীবন শুরু হয়। পরবর্তীকালে আঁতোয়া আর্তোর ‘নিষ্ঠুর নাট্যভাষ্য’ (Theatre of Cruelty) এবং ব্রিটেনের নাট্য নির্দেশক জন লিটিলউডের কর্ম পদ্ধতির দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। পরবর্তীকালে রয়াল শেক্সপিয়র কোম্পানিতে তিনি নির্দেশক হিসেবে যোগদান করেন। সাত দশক ধরে পিটার বৈপ্লবিক নাট্য পদ্ধতিতে শেক্সপিয়রের এক একটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। যার মধ্যে অন্যতম ১৯৭০ সালের ‘দ্য মিডসামার নাইটস ড্রিম’। ট্রাপিজ, সার্কাস পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গোটা প্রযোজনাটি তৈরি হয়। ব্রুক দেখাতে চেয়েছিলেন সভ্যতা আজ কতখানি দোদুল্যমান, বিপজ্জনক। নাট্যনির্মাণ যেন এক আধুনিক শতাব্দীর নব নাট্যতরঙ্গ (New Wave Theatre)-এর জন্য পথ রচনা করছে। স্পেস বা পরিসরের ক্ষেত্রে অভিনেতা ও নাটক (টেক্সট) কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, ইতিহাস কীভাবে কাজ করে দেহ মনের ভিতর সেখান তৈরি হবে ভবিষ্যৎ আধুনিক নাট্য ইস্তেহার ‘The Empty Space’। শেক্সপিয়রের নাটকের মধ্যে দিয়ে বিশ্বমানবের ভাষ্য, সংস্কৃতি ও সংকটের খোঁজ তিনি খুঁজে ফিরছিলেন এক একটি নাট্য প্রযোজনায় এবং পাশাপাশি তৈরি হয়ে উঠছিল Evoking Shakespeare-এর পাণ্ডুলিপি।

এর পাশাপাশি তাঁর হাতে গড়ে উঠেছে চেকভের ‘দ্য চেরি অর্চাড’, আর্থার মিলারের ‘ভিউ ফ্রম দ্য ব্রিজ’। মঞ্চের বাস্তবতার দুই অহং-মিনারকে একটা সময়ের মধ্যে ধরার চেষ্টা করেছেন। যাঁরা ঘটনায়-চরিত্রে উপন্যাসের মহীয়ানতাকে ছুঁয়ে যান, তাঁদের জন্য ডস্টয়েভস্কির মহাগ্রন্থ-সদৃশ উপন্যাসকেও ধরেছেন মঞ্চে, যখন নির্দেশনা দিয়েছেন ‘ব্রাদার্স কারমাজভ’-এ। এর পাশেই আবার রাখা মোৎসার্টের সুরে উদ্বেলিত মিউজিকাল ‘ডন গিয়োভানি’।

নাট্য বৈচিত্র্যে ভরপুর তাঁর জীবন ফ্রান্স থেকে মস্কো, নিউ ইয়র্ক থেকে আফ্রিকা, জার্মানি থেকে ভারতবর্ষ।  

আরও পড়ুন
জেলবন্দিদের জন্য শেক্সপিয়রের নাটক

ব্রিটিশদের ‘সেকেন্ড থিয়েটার’-এর ধারা পৃথিবীর সামনে ততদিন পর্যন্তই ছিল যতদিন পিটার ব্রুক রঙ্গালয়ে প্রবেশ করেননি। লন্ডনের এই সাহেব সারা পৃথিবীকে শেখালেন কোনো বাঁধা পড়াকেই নাটমন্দির না-ভেবে, কেমনভাবে নাট্যমঞ্চকে খাঁচার দিক থেকে নয়, ভাবতে হয় অন্তরে শূন্যতার মুক্তি খুঁজে নিয়ে। শূন্যতার দর্শন থাকলে তবেই স্থাপন করা যায় পূর্ণতর একটি রূপ।

আরও পড়ুন
পরীক্ষানিরীক্ষার সঙ্গে প্রয়োজন ক্লাসিক্যালের অনুশীলনও – ‘বিসর্জন’ নাটক থেকে বার্তা থেস্‌পিয়ান্‌স্‌-এর

ইতিহাস ১৯৭৫ সালে একটা নতুন পথ রচনা করবে। একদিন এক সন্ধ্যায় সংস্কৃতের অধ্যাপক ফিলিপ লেভাস্তিন পিটার ব্রুক ও জাঁ ক্লদ কাইয়েরকে ‘মহাভারত’-এর প্রথম অধ্যায়টি পাঠ করে শোনান। তাঁরা মোহিত হয়ে, এর পর টানা পাঁচ বছর ধরে ফিলিপের কাছে সেই মহাকাব্যপাঠ শুনতে যেতেন। শুধু শুনতেন, আর নোটস নিচ্ছেন। ভারতীয় ছন্দের হিল্লোল ইউরোপীয় রক্তে তৈরি করছে নাট্যস্পন্দন। সাত বছর ধরে পাঠ করার পর তৈরি হলো প্রাথমিক নাটকের খসড়া। এরপর নাট্যপথিক আস্তে আস্তে হয়ে উঠবেন ভারতপথিক। সেখান থেকে তৈরি হবে বিশ্বমানবতার জন্য একটা লং মার্চ। ন ঘণ্টার এই নাটক যা তিনটি অংশে বিভক্ত ‘দ্য গেম অফ ডাইস’, ‘এক্সাইল ইন দ্য ফরেস্ট’, ‘দ্য ওয়ার’-এ, আসলে শতবর্ষে ঘটে যাওয়া যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, জাতি-হত্যা, রাষ্ট্রের ভাঙন— সবটা মিলিয়ে যেন কুরুক্ষেত্রের মাঝে দাঁড়িয়ে খোঁজবার চেষ্টা শান্তির বীজ কোন মাটির মধ্যে বপন করা যায়। পিটার বলছেন, ‘হাজার বছরের প্রাচীন আর্য কিংবা দ্রাবিড় জাতির অন্তর থেকে প্রকাশিত সংলাপ তৈরি করা আজকের পৃথিবীতে সম্ভব নয়, কিন্তু মানবতার জন্য এত বড় একটি কর্মকাণ্ড, ধ্বংস ও শান্তির বৈপরিত্যের মাঝে আত্ম আবিষ্কারের কথা আমি নিয়ে যেতে চাই পশ্চিমে।’ হ্যাঁ, পিটার যেন সৌতির ভূমিকায় নেমে পৃথিবীর মানুষকে মহাভারতের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। মহাকাব্যের পরিসর থেকে এই কাহিনীকে সরিয়ে এনে দর্শকদের উপলব্ধি করাতে চেয়েছিলেন, সভ্যতার এক ভিন্ন দিক। 

আরও পড়ুন
ফেসবুক পোস্ট থেকে জন্ম নিল নাটক, অভিনব উদ্যোগ নির্দেশক দীপঙ্কর সেনের

শুধু মহাভারতই নয়, প্রতিটি প্রযোজনাতেই দর্শকদের আত্মোপলব্ধির সামনে দাঁড় করানোই ছিল পিটার ব্রুকের লক্ষ্য। সেখানেই অনন্য তিনি। কালজয়ীও বটে…

Powered by Froala Editor