কেন্দ্রের প্রতিটি সিদ্ধান্ত থেকেই সূত্রপাত হচ্ছে একেকটি বিতর্কের। কৃষি বিল পাশ হওয়া নিয়ে দেশ জুড়ে চলছে তোলপাড়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তেই প্রতিবাদে সরব হয়েছেন কৃষকরা। তবে এরই মধ্যে সপ্তাহ খানেক আগেই পাশ হয়ে গেছে আরও একটি কৃষি সংক্রান্ত বিল— পেস্টিসাইড ম্যানেজমেন্ট বিল বা কীটনাশক বিল। ১৯৬৮ সালের আইনকে রাতারাতি বদলে ফেলার পরও, অনালোচিতই থেকে গেছে এই নতুন আইনের সংশোধন। যার জেরে নতুন করে বিপদে পড়ার সম্ভাবনাই মাথা চাড়া দিচ্ছে কৃষকদের মনে।
এবার থেকে জমিতে সার কিংবা কীটনাশক ব্যবহার করতে গেলে কৃষকদের চিকিৎসকের থেকে নিয়ে আসতে হবে প্রেসক্রিপশন। না হলে দোকান থেকে কেনা যাবে না কৃষির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সামগ্রীগুলিই। এমনটাই উল্লেখিত হয়েছে সম্প্রতি পাশ হওয়া কীটনাশক বিলে। এখন রাসায়নিক সার, চিকিৎসক এবং প্রেসক্রিপশন— এই তিনটি শব্দের ওপর ভিত্তি করে এই বিলের মূল বক্তব্যটা বোঝাই বেশ জটিল। কীভাবে চিকিৎসকরা জুড়ে গেলেন কৃষির সঙ্গে?
“২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘সয়েল হেলথ কার্ড’ নামে একটি প্রোজেক্ট এসেছিল সেন্ট্রাল গভার্নমেন্ট থেকে। যাতে প্রতিটি জমির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে, সেই জমিতে কী ধরণের সার কত পরিমাণ ব্যবহৃত হবে তার হিসাব দেওয়া হয়েছিল। বহু কৃষককেই দেওয়া হয়েছিল এই কার্ড। মোবাইল নম্বর রেজিস্টার করলে সেখানেও মাটির স্ট্যাটাস পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল কেন্দ্র। হায়দ্রাবাদ এর পর প্রথম ‘ক্রপ ডক্টর’ নামের একটি কাউন্সিল তৈরি করেছিল। এই ক্রপ ডক্টরদের কাজই হল জমির গুণগত মান কার্ড দেখে যাচাই করা এবং তার ভিত্তিতে কৃষকদের প্রয়োজনীয় সার ব্যবহার করতে প্রেসক্রিপশন তৈরি করে দেওয়া”, চুঁচুড়া ধান্য গবেষণা কেন্দ্রর মৃত্তিকা বিজ্ঞানী কৌশিক মজুমদার বিশদে বর্ণনা করলেন বিষয়টির।
অতিরিক্ত রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে মাটির মধ্যে দিয়েই তা মেশে প্রকৃতিতে। যা একার্থে দূষণই ঘটিয়ে ভূগর্ভস্থ জলে। পাশাপাশি অনেক রাসায়নিকের ব্যবহার হয়, যেগুলির উপকারিতা কমে যাওয়ায় বন্ধ করেছে সরকার। আবার কিছুক্ষেত্রে তাদের ক্ষতিকর প্রভাবও রয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেগুলির ব্যবহার অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত হবে এই বিলের কর্মসূচির মাধ্যমে। “গ্লাইফোসেট নামে একটি ঘাস মারার কীটনাশক রয়েছে। যার কার্সিনোজেনিক এফেক্ট লক্ষ্য করা গেছে। এর ব্যবহারে ক্যানসার হতে পারে মানুষের দেহে। কিন্তু এখনও বহু প্রান্তিক অঞ্চলে এই কীটনাশক বিক্রি হয় এবং নির্দ্বিধায় ব্যবহৃত হয় কৃষিকাজে। কীটনাশক বিলের আওতায় পুরোপুরি বন্ধ হবে এই ধরনের ওষুধের ব্যবহার।”, জানালেন কৌশিকবাবু।
সত্যিই তো কৃষির গুণগত মাণ সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা যদি নির্ধারিত হয় বিলের মাধ্যমে। তবে আপত্তি কোথায়? কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে ইতিবাচক দিকগুলো চোখে পড়লেও ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে অন্য একটা জায়গায়। এখনও অবধি হায়দ্রাবাদ ছাড়া ভারতের আর কোনো অঞ্চলেই সেইভাবে নেই এই ‘ক্রপ ডক্টর’ কিংবা কৃষি চিকিৎসকদের অস্তিত্ব। নেই সর্বভারতীয় স্তরে ক্রপ ডক্টরদের কোনো মেডিক্যাল কাউন্সিলও। তবে কীভাবে পরিচালিত হবে এই কর্মকাণ্ড? সে বিষয়ে কোনো উত্তরই জানা নেই কারোর।
দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থার জেরেই সমস্তরকম নিয়োগের প্রক্রিয়াতেই ঝাঁপ ফেলেছে সরকার। তারই মধ্যে নতুন করে কতজন ক্রপ ডক্টরদের নিয়োগ করা হবে, বিষয়টি যথেষ্ট সন্দেহজনক। যদি হয়েও থাকে তবে প্রতি জেলা পিছু হয়তো মোতায়েন করা হবে একজন ক্রপ-ডক্টরকে। কিন্তু আদৌ কি তাঁর পক্ষে সমগ্র জেলার কৃষকদের জমির জন্য সময় মতো প্রেসক্রিপশন বানিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে? নাকি প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে সম্ভব প্রয়োজনীয় সারের জন্য দিনের পর দিন ক্রপ-ডক্টরের অফিসে লাইন দেওয়া? ৩৬৫ দিন রোদ, জল, বৃষ্টি নিয়েই মাঠের মধ্যে যাঁদের কাজ তাঁরা আদৌ কি উৎসাহ দেখাবেন কাজ ছেড়ে হত্যে দিয়ে পরে থাকতে প্রেসক্রিপশনের জন্য? সাধারণ যৌক্তিকতার সঙ্গেই খাপ খায় না এই পরিকল্পিত রূপরেখা।
আরও পড়ুন
২০০ বছর আগের যে নীতি ভেঙে দিয়েছিল ভারতীয় কৃষি-সভ্যতার ভিত
তবে এখানেই শেষ নয় জটিলতার। কৃষি বিলের মাধ্যমে কৃষিকাজের ওপর নিয়ন্ত্রণে আগে থেকেই হাত সরিয়ে নিয়েছে সরকার। এই ‘বেসরকারিকরণ’-এ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গেই সরাসরি কাজের বরাত পাবেন কৃষকরা। তাঁরাই ধার্য করবেন ন্যূনতম ফসলের দাম। একটা সময় আইনি জটিলতার কারণে কৃষকরাও শরণাপন্ন হবেন এই বহুজাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলির কাছে। এবং একইভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হওয়ার পর তাঁদের মাধ্যমেই প্রেসক্রিপশন পৌঁছে যাবে কৃষকদের কাছে। ফলে সেখানেও এই সংস্থাগুলিই পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে কোন জমিতে কোন ফসলের চাষ হবে। স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে কৃষকদেরই।
কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করার মূল পথই হল উপযুক্ত পদ্ধতিতে ফসলের রক্ষা করা, তা কীটনাশকই হোক কিংবা সারের ব্যবহারে। কিন্তু কীটনাশক বিল সেই কাজটাকেই অযথা জটিলতার মধ্যেই কি ঠেলে দিল না? উত্তর জানা নেই...
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
আরও পড়ুন
কোথাও রেল-রোকো, কোথাও পথ অবরোধ; কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সাক্ষী গোটা দেশ
Powered by Froala Editor