পার্সি ফসেটের অভিযান ও আমাজনের হারানো শহর ‘জি’

প্লেটো বর্ণিত আটলান্টিস থেকে শুরু করে হিমালয়ের শাম্ভালা, কানলান শহর, লাতিন আমেরিকার এল ডোরাডো, থিমিস্কিরা— উনিশ শতকের শেষের দিক থেকেই নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছিল এইসব প্রাচীন পৌরাণিক নগরীদের নিয়ে। তাদের নিয়ে হামেশাই প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় সে-যুগের সংবাদপত্রেও। চলত বিভিন্ন অভিযান। শেষ পর্যন্ত সেভাবে সাফল্য পাননি কেউ-ই। তবে শুধুমাত্র এইসব রহস্যময় শহরের সন্ধানে নেমেই বহু অভিযাত্রী জায়গা করে নিয়েছিলেন ইতিহাসের পাতায়। আর সেই তালিকায় অন্যতম এক নাম পার্সি ফসেট (Percy Fawcett)। 

কে এই পার্সি ফসেট? তিনি পেশায় সৈনিক, আবার কার্টোগ্রাফারও বটে। ইতিহাস এবং ভূগোলের প্রতিও প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর। সেই সূত্র ধরেই তিনি নাম লেখান অভিযাত্রীদের তালিকায়। তবে সোনা-দানায় মোড়া গুপ্তনগরী খুঁজতে গিয়েই নিঁখোজ হতে হয় তাঁকে। কিন্তু কোন নগরের অনুসন্ধানে পথে নেমেছিলেন তিনি? 

‘দ্য সিটি অফ জি(Z)’। ফসেটের প্রস্তাবিত সেই রহস্যময় শহরের নাম এমনই। কিন্তু কোথায় অবস্থিত এই শহর? কোথা থেকেই-বা এই শহরের সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন তিনি?

এই গল্পের শুরু ভারতীয় উপমহাদেশ থেকেই। ১৮৬৭ সালে ইংল্যান্ডের ডেভন শহরের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম ফেসেটের। ছোটো থেকেই খেলাধুলো ও শরীরচর্চার অভ্যাস থাকায় সেনাবাহিনীতে সুযোগ পেতে ফেসেটের অসুবিধা হয়নি খুব একটা। ১৮৮৬ সালে রয়্যাল আর্টিলারিতে যোগ দেন তিনি৷ ছিলেন কামান-চালক বা গোলন্দাজ। প্রাথমিকভাবে ব্রিটেনে কিছুদিন রাখা হলেও, পরে তাঁকে পাঠানো হয় সিংহল অর্থাৎ বর্তমান শ্রীলঙ্কায়। 

ভারতীয় উপমহাদেশে পা ফেলার পর ক্রমশ এই নতুন দেশের প্রতি আকর্ষণ বাড়তে থাকে তাঁর। এমনকি স্থানীয় এক মহিলাকে বিবাহ করে, স্থায়ী বসতিও স্থাপন করেন সিংহলে। অভিযাত্রা কিংবা রহস্যময় গুপ্তশহরের প্রতি ফেসেটের গভীর আগ্রহ জন্মায় শ্রীলঙ্কান স্ত্রী নিনার সূত্রেই। অবসর সময়ে নিনা ভারতীয় উপমহাদেশের নানা রহস্য, পৌরাণিক কাহিনি শোনাতেন ফসেটকে। সেখান থেকেই হারানো শহর দ্বারকা কিংবা তিব্বতের শাম্ভালা নিয়ে পড়তে শুরু করেন তিনি। শুধু পড়াশোনা নয়, সেনাবাহিনী থেকে ছুটি পেলেই বেরিয়ে পড়তেন ভারত-দর্শনে৷ কখনও ছুটেছেন বর্তমান পাকিস্তানে, কখনও আবার হিমালয়ে।

তবে বৃহত্তর অর্থে তাঁর অভিযান শুরু হয় এর বেশ কয়েক বছর পর। ততদিনে দেশের নানাপ্রান্তে ঘুরে বেড়ানোর জন্য ব্রিটিশ বাহিনিতে বেশ নামডাকও হয়েছে তাঁর। সেই সূত্রেই ১৯০৬ সাল তাঁর কাছে সুযোগ আসে লাতিন আমেরিকা ভ্রমণের। আমাজনে যেতে হবে কার্টোগ্রাফার হিসাবে। তৈরি করতে হবে ম্যাপ। 

না, সুযোগটা হাতছাড়া করেননি তিনি। ১৯০৬ থেকে শুরু করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত আমাজনেই কেটেছে তাঁর। একদিকে যেমন আমাজনের অরণ্যে ঘুরে ঘুরে খুঁজে নতুন পথ বার করেন পার্সি, তেমনই সেখানকার আদিবাসীদের মুখে শোনা নানা পৌরাণিক কাহিনি সাজিয়ে তৈরি করেন এক কাল্পনিক শহরের তত্ত্ব। আর সেই শহরের নামই হল ‘জি’। ১৯১২ সালে এই তত্ত্ব প্রকাশ্যে আসার বছর খানেক আগেই আবিষ্কৃত হয়েছে চিলির প্রাচীন শহর মাচুপিচু। ফলে ফসেটের তত্ত্বকে নেহাত ফেলে দেননি সে-যুগের মানুষ। 

অবশ্য তৎক্ষণাৎ এই আশ্চর্য শহরের অনুসন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেননি পার্সি। ডাক এসেছিল সেনাবাহিনী থেকে। ইউরোপে বেজে উঠেছে বিশ্বযুদ্ধের ঘণ্টা। ফলে পুরনো ভূমিকায় ফিরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। যদিও যুদ্ধে গেলেও থেমে থাকেনি তাঁর ভাবনা। বিশ্বযুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে বসেই শুরু করেছিলেন গবেষণা। সেই সূত্র ধরেই তিনি খুঁজে পান এক পর্তুগিজ অভিযাত্রীর বহু পুরনো একটি ডায়েরি। সেখানে উল্লেখিত ছিল সোনায় মোড়া প্রকাণ্ড এক নগরীর কথা। আর সেই নগর নাকি লুকিয়ে রয়েছে আমাজনের বুকেই। 

দুয়ে দুয়ে চার করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি ফসেটের। তাঁর স্বপ্নের ‘সিটি অফ জি’-ই এই হারানো নগরী, দাবি করেন ফসেট। শুরু হয়ে যায় অভিযানের তোরজোড়। ১৯২১ সাল। প্রথমবার এই নগরীর সন্ধানে আমাজনে পাড়ি দিয়েছিলেন ফসেট। অবশ্য সেবার ম্যালেরিয়ায় কাবু হয়ে তিন মাসের মধ্যেই ফেরত আসতে হয়েছিল তাঁকে। তবে ব্রিটেন তথা বিশ্বের সংবাদপত্রের রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় তাঁর এই অভিযান, অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার কথা। রাতারাতি তারকা হয়ে ওঠেন ফেসেট। ফলে দ্বিতীয়বার অভিযানের জন্য আর্থিক তহবিল তৈরি করতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি তাঁর। রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, রকফেলার ইনস্টিটিউট ও ব্রিটেনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাই অর্থ জোগাড় করে দেয় তাঁকে। 

১৯২৫ সাল। ব্রিটেনকে বিদায় জানিয়ে ফসেট পাড়ি দিয়েছিলেন তাঁর অভিযানে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ছেলে জ্যাক, এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাইমেল। তাছাড়া আমাজনে পৌঁছে বেশ কিছু ব্রাজিলিয়ান মানুষকেও সামিল করেছিলেন তাঁর দলে। অবশ্য এই অভিযান সফল হবে কি হবে না— তা নিয়ে অনিশ্চিত ছিলেন তিনিও। নিজেই সাবধান করে গেছিলেন, তিনি ২ বছরের মধ্যে ফিরে না-এলে যেন ধরে নেওয়া হয় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। কোনোভাবেই যেন আমাজনে তাঁর সন্ধানের জন্য লোক পাঠানো না-হয়, কারণ সেখানে নাকি অপেক্ষারত আছে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। 

প্রাথমিকভাবে অভিযান চলছিল তাঁর নিজের গতিতেই। আমাজনের গহীন অরণ্য থেকেও স্থানীয় কর্মচারীদের দিয়ে বাড়িতে চিঠিপত্র পাঠাতেন তিনি। ১৯২১-এর নভেম্বর মাসে বেশ দুঃখ করেই স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় ঘোড়া মারা গেছে অরণ্যে। মানচিত্র পাঠিয়ে জানিয়েওছিলেন প্রিয় ঘোড়ার স্মরণে তিনি জায়গাটির নাম রেখেছেন ‘ডেড হর্স ক্যাম্প’। সেই-ই শেষ চিঠি। সেটাই ছিল সভ্য জগতের সঙ্গে ফসেটের শেষ যোগাযোগ। 

মাস খানেকের মধ্যেই ফসেটের এই অন্তর্ধান সাড়া ফেলে দেয় গোটা বিশ্বজুড়ে। দু’বছর কেটে যাওয়ার পর ধরে নেওয়া হয় মৃত্যু হয়েছে তাঁর। সেইসঙ্গে তাঁর পাঠানো ম্যাপ ধরেই আমাজনে পাড়ি দেন বহু ইউরোপীয় অভিযাত্রী। পাড়ি দিয়েছিলেন বহু সাংবাদিকও। লাভের লাভ হয়নি কিছুই। বরং উল্টে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ফসেটকে খুঁজতে গিয়েই প্রাণ হারান শতাধিক মানুষ। 

অনেকে দাবি করেন ফসেট মারা গিয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। আবার কারোর মতে গুপ্ত শহরের সন্ধান পেলেও, সম্পত্তি একা আত্মস্থ করার জন্য গহীন অরণ্যে গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব হল, আদিবাসীদের হাতেই প্রাণ গিয়েছিল তাঁর। ২০০৫ সালে এক সাংবাদিক ডেভিড গ্রানের সৌজন্যে প্রকাশ্যে আসে এই তত্ত্ব। আমাজনের কালাপালো উপজাতিকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করার সময় ফসেটের প্রসঙ্গ তোলেন ডেভিড। সে-সময় বেশ কিছু প্রবীণ আদিবাসী নাকি ফসেটের বর্ণনা শুনে চিনতে পেরেছিলেন তাঁকে। ছবি দেখে চিহ্নিতও করেছিলেন ফসেটকে। তাঁদের কথা অনুযায়ী, ফসেট শিকার হন ফায়ার্স ইন্ডিয়ান নামের এক হিংস্র উপজাতির হাতে। যদিও আজও এই তত্ত্বকে নিশ্চিত করে বলার সুযোগ আসেনি মানুষের হাতে। শুধু ‘সিটি অফ জি’ হয়ে উঠেছে সিনেমার প্রেক্ষাপট। লেখা হয়েছে বিস্তর গল্প-উপন্যাসও। আর সেই লেখক তালিকায় সর্বপ্রথম নাম লিখিয়েছিলেন খোদ শার্লকস্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল!

Powered by Froala Editor