সারা পৃথিবীতে করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ কোটির শৃঙ্গ। এখনও অবধি পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে এই মারণ ভাইরাসের আক্রমণে। কিন্তু করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরেও তা থেকে সুস্থ হওয়ার হারও বেশ আশাব্যঞ্জক। এখন অবধি প্রায় ৬০ লক্ষ করোনা আক্রান্ত রোগী সুস্থও হয়ে উঠেছেন।
গোড়া থেকেই চিকিৎসকেরা বারংবার সাবধান করে আসছিলেন যে বয়স্ক মানুষেরা এবং শিশুরা, যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে কম, তাদেরই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। কিন্তু যে সকল রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠেছেন, তাদের মধ্যে বেশ কিছু মানুষের ক্ষেত্রে এই ঘটনা প্রায় অলৌকিকেরই শামিল। অর্থাৎ আপনজন থেকে শুরু করে চিকিৎসকেরা অবধি কেউই ভাবতে পারেননি, করোনা ভাইরাসের হাত থেকে সুস্থ হয়ে প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পারবেন এনারা।
যেমন ধরা যাক ভারতবর্ষের কেরালার থমাস এবং তার স্ত্রী মারিয়াম্মার কথা। ৯০ বছর বয়সী থমাস এবং তাঁর থেকে দু’বছরের ছোট মারিয়াম্মা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পরেও সুস্থ হয়ে উঠেছেন চিকিৎসকদের চেষ্টায়। যদিও চিকিৎসকদের কথা অনুযায়ী এই বয়স্ক দম্পতির অবস্থা ছিল রীতিমতো আশঙ্কাজনক। তাই টমাস এবং মারিয়াম্মার সুস্থ হয়ে ওঠা যেন আশার আলো দেখিয়েছিল আরও হাজার হাজার করোনা আক্রান্তকে।
তেমনি আমেরিকার সিয়াটেলের বাসিন্দা ৯০ বছর বয়সী জেনিভা উড হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছিলেন সেখানকার একটি হাসপাতালে। চিকিৎসা চলাকালীনই তিনি সেখানে আক্রান্ত হন এই ভাইরাসে। পরবর্তীকালে জানা যায় যে, সেই হাসপাতালের লাইফ কেয়ার সেন্টারে ভর্তি ১৩০ জন বয়স্ক রোগীর মধ্যে ৬২ শতাংশই আক্রান্ত হয়েছিলেন করোনা ভাইরাসে। কিন্তু উড রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠবেন। ধীরে ধীরে চিকিৎসায় সাড়া দিতে শুরু করেন ৯০ বছর বয়সী মহিলা এবং কয়েক সপ্তাহ পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয় হাসপাতাল থেকে।
এই প্রসঙ্গে অবশ্যই আসবে আমেরিকার ১০৪ বছর বয়সী বিল ল্যাপসিয়ের কথা। শুধুমাত্র করোনা ভাইরাস নয়, এর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো মানব ধ্বংসকারী যজ্ঞ থেকেও বেঁচে ফিরেছেন তিনি। ল্যাপসিয়ের ছিলেন আমেরিকার সেনাবাহিনীর সদস্য। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বিলের ক্ষেত্রে সব থেকে যেটা আশ্চর্যজনক ছিল সেটা হল, ১০০ বছরের বেশি বয়স হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রে যে ধরনের শ্বাসকষ্টের সমস্যা থাকে, সেটা একদমই দেখা যায়নি তাঁর বেলায়।
করোনার সঙ্গে যুদ্ধে জয়ীদের মধ্যে অন্যতম চিনের শতায়ুবর্ষীয় এক ব্যক্তি, যিনি অ্যালজাইমার্স, হাইপারটেনশন এবং হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার মতো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন কোভিড-১৯ দ্বারা। প্রথাগত চিকিৎসায় কাজ দিচ্ছে না দেখে ডাক্তারেরা প্রাচীন চিনা পদ্ধতিতেও চিকিৎসা করেন সেই ভদ্রলোকের। করা হয় অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা এবং প্লাজমা থেরাপিও। যদিও প্রাণে বাঁচার আশা ছিল খুবই ক্ষীন। চিকিৎসা জগৎকে উচ্ছ্বাসের যথেষ্ট সুযোগ দিয়ে, কয়েক সপ্তাহ পরেই সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরে যান সেই ব্যক্তি।
আরও পড়ুন
করোনা টেস্টে আক্রান্তের হারে দেশের সার্বিক গড়কেও ছাপিয়ে গেল রাজ্য
কিংবা ধরা যাক, ইথিওপিয়ার টিলাহুন উল্ডমাইকেল। আফ্রিকার দেশগুলিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের হার তুলনামূলকভাবে কম হলেও ১১৪ বছর বয়সী ইথিওপিয়ার এই খ্রিস্টান সন্ন্যাসী আক্রান্ত হয়েছিলেন মারণ ভাইরাসে। চিকিৎসকদের প্রাণপণ চেষ্টায় প্রাণ ফিরে পাওয়ায়, বর্তমানে টিলাহুন এই পৃথিবীর অন্যতম বয়স্ক ব্যক্তি, যিনি জয়ী হয়েছেন এই ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধে।
করোনা ভাইরাসকে খেলায় হারিয়ে জয় করার প্রসঙ্গে সাম্প্রতিক অতীতে বারবার উঠে এসেছে স্পেনের আদা জানুসোর নামও। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত দেশগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল স্পেন। স্পেনেরই ১০৪ বছর বয়সী আদা জানুসো জ্বর, বমি এবং শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে ভর্তি হন হাসপাতালে। পরীক্ষায় করোনা আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা যায় এই মহিলা। চিকিৎসকদের তৎপরতায় সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এবং তারপরেই সামনে আসে একটি অবাক করা তথ্য যে, প্রায় ১০০ বছর আগে ঘটা স্প্যানিশ ফ্লুয়ের আক্রমণেও প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন আদা। সেই সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল মহামারী স্প্যানিশ ফ্লুয়ের কারণে।
তবে শুধুমাত্র বয়স্করাই নয়, সদ্যজাত শিশুরাও যথেষ্ট প্রত্যয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের ছাপ রেখেছে এই অতিমারীর সংকটে। চিকিৎসকদের অবাক করে অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গিয়েছে ব্রাজিলের একটি ৫ মাসের শিশু। কোমাতে চলে যাওয়ার ফলে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়েছিল শিশুটিকে। তাও যেভাবে সে করোনাকে হারিয়ে ফিরে এসেছে জীবনের পথে, তাকে ‘অলৌকিক’ ছাড়া আর কিছুই বলতে রাজি নন চিকিত্সকেরাও। তেমনই ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের ৬ মাসের শিশু এরিনের কথাও অবশ্যই বলতে হয় এই প্রসঙ্গে। জন্মের মাত্র দু’মাস পরেই ওপেন হার্ট সার্জারি করতে হয়েছিল এরিনের। তারপরেও করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে, খুবই কম আশা ছিল ছোট্ট এরিনের প্রাণে বাঁচার। কিন্তু এক্ষেত্রেও যেভাবে মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ফিরে এসেছে শিশুটি, সেই প্রসঙ্গে ডাক্তাররাই বলছেন, “অলৌকিক ছাড়া আর কি বলব বলুন!”
আরও পড়ুন
করোনায় আক্রান্ত রঞ্জিত মল্লিক ও তাঁর মেয়ে কোয়েল, রয়েছেন সেলফ কোয়ারেন্টাইনে
Powered by Froala Editor