ডেনভারের ‘দেশে’ গানেই আরোগ্য খোঁজেন মানুষরা

লম্বা করিডরে অপেক্ষারত বেশ কিছু মানুষ। করিডরের উল্টোদিকের একটা দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলেন মাঝবয়সি এক ভদ্রলোক। তাঁর পোশাক আর হাতে ধরা খাতা থেকে দিব্যি বোঝা যায়, তিনি পেশায় কম্পাউন্ডার। পরবর্তী রোগী দেখার জন্য ডাক পাঠিয়েছেন চিকিৎসক। এবার আপনার পালা। তবে চিকিৎসকের চেম্বারে ঢুকলেই রীতিমতো চমকে উঠবেন আপনি। ডাক্তারের ঘরে যে নীরবতা দেখে অভ্যস্ত আপনি, তার বিন্দুমাত্রও নেই সেখানে। বরং, হালকা গান বাজছে স্পিকারে। গুন গুন করে তাতে গলা মেলাচ্ছেন স্বয়ং চিকিৎসক। এবার আরও খানিকটা অবাক করে দিয়েই তিনি হাতে তুলে নিলেন টেবিলের পাশে রাখা একটি ব্যাঞ্জো (Banjo)। আপনার শারীরিক সমস্যার কথা শুনতে শুনতেই আপন খেয়ালে গান ধরলেন তিনি। দুলছে তাঁর শরীরও। 

এটা ডাক্তারখানা নাকি কনসার্ট হল? চিকিৎসকের এমন আচরণে প্রাথমিকভাবে বিরক্ত হওয়ার কথা যে কারোর। তবে আমেরিকার ছোট্ট টাউন ফ্লয়েড কাউন্টিতে (Floyd County) পৌঁছে গেলে এমনই অবাক করা অভিজ্ঞতার সাক্ষী হতে হবে আপনাকে। শুধু ডাক্তারখানাই নয়, জিমনাশিয়ামে গেলেও দেখতে পাবেন একই ছবি। কান্ট্রি মিউজিকের তালে নাচতে নাচতেই প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন জিম ট্রেনার। 

এবার ফ্লয়েড কাউন্টির আরেকটা পরিচয়ের কথা বলা যাক। ডেনভারের (John Denver) ‘কান্ট্রি রোড’ গানটার কথা মনে আছে কি? “অলমোস্ট হেভেন, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া/ ব্লু রিজ মাউন্টেন, স্যানেনডোয়া রিভার…” হ্যাঁ সেই ডেনভারের সেই পাহাড়ে মোড়া স্বর্গরাজ্য ভার্জিনিয়ারই (Virginia) ছোট্ট টাউন ফ্লয়েড কাউন্টি। অবশ্য ডেনভারের জন্মভূমি ভার্জিনিয় নয়। তবে ডেনভারের এই গানকেই জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গ্রহণ করেন ভার্জিনিয়ার মানুষরা। ফলে, নাগরিক না হয়েও এদেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছেন জন ডেনভার। বলাই বাহুল্য, এই শহরের সমস্ত মানুষের সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং লোকসঙ্গীত। 

ফ্লয়েড কাউন্টির কথা উঠলে, উল্লেখ করতে হয় ভার্জিনিয়ার স্থানীয় চিকিৎসক জো স্মিডি’র কথা। আমেরিকার খ্যাতনামা লোকসঙ্গীত শিল্পী এবং সঙ্গীত সংগ্রাহক পাপা জো স্মিডির সন্তান তিনি। ছোটোবেলা থেকেই সঙ্গীতের আবহে বড়ো হয়েছেন জুনিয়র জো। বাবার থেকে নিজেও শিখেন ব্যাঞ্জোবাদন। বেশ কিছু স্বরচিত গানও রয়েছে তাঁর। চিকিৎসাকে পেশা করে নেওয়ার পরেও সঙ্গীতের সঙ্গে সেই সম্পর্কে চ্ছেদ পড়েনি। বরং, সঙ্গীতকেই তিনি হাতিয়ার করে নিয়েছেন চিকিৎসার। বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে নিজের চেম্বারেই গান-বাজনা করে চলেছেন জো। গানের তালে তালেই চলে তাঁর রোগী দেখা। বিশ্বাস, গানের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে উদারতা। আর তা স্বাস্থ্য পরিষেবারই একটা অঙ্গ। আরও অবাক করার বিষয় হল দরিদ্র মানুষদের থেকে এক পয়সাও নেন না তিনি। আবদার একটাই। তাঁর সঙ্গে গলা মেলাতে হবে গানে। পাশাপাশি সঙ্গীত যেকোনো মানুষের মনকে শান্ত করে দিতে পারে। আর মন ভালো থাকলে তবেই না ভালো থাকবে শরীর। এমনটাই ধারণা তাঁর।

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের ‘নির্জন এককের গান’ ও ঋতু গুহ 

স্মিডির দেখানো এই পথেই বর্তমানে হাঁটছেন ভার্জিনিয়ার অন্যান্য চিকিৎসকরাও। এমনকি রীতিমতো চমকে উঠতে হয় রোগীর প্রেসক্রিপশনে গানের অ্যালবামের নাম দেখলে। সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা তো বটেই গোটা বিশ্বজুড়েই চল বেড়েছে মিউজিক থেরাপির। আমেরিকান মিউজিক থেরাপি অ্যাসোসিয়েশনের চিকিৎসকরাও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন, গানের সঙ্গে সরাসরি থেরাপিউটিক সম্পর্ক রয়েছে মানুষের শারীরিক অবস্থারও। পরীক্ষায় ইতিবাচক ফলও মিলেছে তার। তবে ভার্জিনিয়ায় এই রীতি চলে আসছে কয়েক যুগ আগে থেকেই। নেপথ্যে জো স্মিডি জুনিয়র। আর ভার্জিনিয়ার সাধারণ মানুষ? তাঁরাও তো জড়িয়ে রয়েছেন এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। স্মিডির হাত ধরে তাঁরাও আরোগ্যের সন্ধান করে চলেছেন ছন্দে ছন্দে। ভার্জিনিয়ার এই সঙ্গীতযাপন দেখলে অবাক হওয়ার অবকাশ থাকে না কোনো অংশেই…

আরও পড়ুন
হাসান আজিজুল হক, গান ও গানের বাগান

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অন্যদের বারণ সত্ত্বেও উড়ান, মাত্র ৫৩ বছরেই বিমান-দুর্ঘটনায় মৃত জন ডেনভার

Latest News See More