দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার একটি ছোট শহর কুবার পেডি। এখানকার বেশিরভাগ মানুষের বাস মাটির নিচে। শুনে অবাক লাগলেও এটাই সত্য। অ্যাডিলেডের উপকূলীয় সমভূমি থেকে ৮৪৮ কিমি উত্তরে এগিয়ে গেলেই রহস্যময় বালি-পিরামিডের আকীর্ণ অংশ। চারপাশ জনশূন্য। হাওয়া দিলে গোলাপি ধুলো ওড়ে। বালিয়াড়ি অবিরাম বিস্তৃত। আর বালির খাঁজে উঁকি দেয় কাঁটা ঝোপ।
হাইওয়ে ধরে কিছুটা এগিয়ে গেলে রহস্যময় এই এলাকায় আরও কিছু আবির্ভূত হয়। দেখা মেলে স্মৃতিস্তম্ভের মতো অগোছালোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ফ্যাকাশে মাটির স্তূপ। মাঝেমাঝেই এখানে সাদা পাইপ মাটি থেকে বেরিয়ে আরেকটার সঙ্গে মানিকজোড়।
প্রায় ২,৫০০ মানুষের বাস ওপাল খনির শহর কুবার পেডিতে। ওপাল মহামূল্যবান দুগ্ধপাথর। গ্রহের অবস্থা খারাপ হলে জ্যোতিষশাস্ত্রের পরামর্শে এই সাদাপাথর ভারতে অনেকেই রেমেডি হিসাবে ধারণ করেন। কুবার পেডি ওপালের রাজধানী হিসাবেও পরিচিত। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ওপাল খনি এখানেই। গ্রামের শোভা বাড়িয়েছে কয়েক দশকের খননের ফলে বর্জ্য মাটির স্তূপ। তবে, এখানকার স্থানীয় বিশেষত্বের প্রমাণ ভূগর্ভস্থ জীবনযাপন। আন্ডারগ্রাউন্ড সিস্টেমের অধিকাংশই খননের উদ্দেশ্যে। একশো বছর আগে খনির শ্রমিকরা এর মধ্যেই বাঁধেন ঘর। তখন থেকেই শান্তিতে বসবাস।
বিশ্বের এই কোণে জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ লৌহ-সমৃদ্ধ বেলেপাথর এবং সিলস্টোন শিলায় নির্মিত বাড়িতে বাস করেন। মাটির নিচের এই ঘরগুলো বেশ সাজানোগোছানো। বাইরে থেকে এইসব বাসস্থান দেখতে সাধারণ মনে হলেও ভেতরের দৃশ্য কোনো পাঁচতারা হোটেলের চেয়ে কম নয়। সমস্ত সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন এরকম প্রায় দেড় হাজার ঘর রয়েছে এখানে। ঘরগুলির ডাকনাম ‘ডাগআউট’। হলিউডের বহু সিনেমার শ্যুটিং স্পটও এই শহর। ২০০০ সালের ‘পিচ ব্ল্যাক’ সিনেমার শ্যুটিং শেষ হওয়ার পর ছবিটিতে ব্যবহৃত স্পেসশিপ এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়নি। এখন যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
আরও পড়ুন
তাঁবুর নিচে দূতাবাস! ৫০-এ পা দিল অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসী অধিকার আন্দোলনের পীঠস্থান
সেই ১৯১৫ সালে কুবার পেডিতে খনির কাজ শুরু। শহরটি মরুভূমিতে। তাপমাত্রা গ্রীষ্মে খুব বেশি তো শীতকালে খুব কম। একসময় এই কারণেই এখানকার বাসিন্দাদের নানান সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। বাঁচার সমাধান হিসাবে খালি পড়ে থাকা খনির ভিতর বসবাস করতে চলে যান তাঁরা। এখন কুবার পেডির এই ভূগর্ভস্থ বাড়িগুলিতে গ্রীষ্মে এসি বা শীতকালে রুম হিটারের প্রয়োজন হয় না।
আরও পড়ুন
মাটির নিচে ২ হাজার বছরের প্রাচীন শহর, ঘরে-ঘরে পানীয় জলের পরিষেবা!
গুহাবাসী মানুষকে ট্রোগ্লোডাইট বলে। অস্ট্রেলিয়ার এই গ্রামের মানুষও গুহাবাসী থুড়ি খনিবাসী। তাঁদের এই ট্রোগ্লোডাইট জীবনধারা অনেকের কাছেই বিস্ময়ের। শীতকালে একরকম, কিন্তু প্রখর গ্রীষ্মে? কুবার পেডি শব্দবন্ধটি একটি আদিবাসী অস্ট্রেলিয়ান শব্দ। মোটামুটি একটা অনুবাদ করলে যার অর্থ ‘গর্তে সাদা মানুষ’। গ্রীষ্মে এই এলাকার তাপমাত্রা থাকে ৫২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এত গরমে পাখিরাও সম্ভবত আকাশ থেকে পড়ে যায়। কিন্তু ছোট্ট এই এলাকার মানুষ ভূগর্ভে থাকেন বহাল তবিয়তে।
জাপানি বোমার হাত থেকে বাঁচতে ট্রেঞ্চ খোঁড়ার কথা অনেকেই জানেন। চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত চংকিং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে এই শহরেও ভূগর্ভস্থ আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়েছিল। সম্প্রতি জুন থেকে সেপ্টেম্বরে গ্রীষ্ম মরশুমে ওই আশ্রয়কেন্দ্রগুলি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। লোকজন গ্রীষ্মের উত্তাপ থেকে বাঁচতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার এবং ‘কেভ হটপট’ (গুহা রেস্তরাঁ)-এ ভিড় জমান। পানীয়, বোর্ড গেমস, টিভি প্রোজেক্টর দিয়ে সমৃদ্ধ গুহা রেস্তরাঁগুলি দারুণ জমজমাট। শহরটি যখন প্রবল তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, এই রেস্তরাঁগুলিই ছিল অন্যতম জিরোনোর স্থান। চংকিং কি কুবার পেডির বাসিন্দাদের থেকে উদ্বুদ্ধ?
শেখার কোনো শেষ নেই। কারণ কুবার পেডি বিশ্বের প্রথম বা বৃহত্তম ভূগর্ভস্থ বসতি নয়। তারাও শিখেছে কারো না কারো কাছে। অথবা তা সহজাতও হতে পারে। আবহাওয়া তার খামখেয়ালিপনা দেখিয়েছে অতীতেও। ইতিহাস তার সাক্ষী। মানবসভ্যতার আদিতে গুহামানবের সংগ্রাম ইতিহাসে পড়া। ২০ লক্ষ বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি গুহায় আমাদেরই পূর্বপুরুষদের ব্যবহৃত অস্ত্র আবিষ্কার হয়েছে। তুষার যুগে নিয়ান্ডারথালরা স্ট্যালাগমাইটের স্তূপ তৈরি করেছিল ১৭৬,০০০ বছর আগে। এমনকী শিম্পাঞ্জিদেরও দক্ষিণ-পূর্ব সেনেগালে দিনের চরম উত্তাপ থেকে বাঁচতে গুহায় ঠান্ডা হতে দেখা গেছে। বেঁচে থাকতে গেলে মানুষকে সহজাতভাবে অনেক কিছুরই আশ্রয় নিতে হয়। কুবার পেডির মানুষের এই ভূগর্ভস্থ বসতভিটে তেমনই স্বকীয়, সহজাত।
Powered by Froala Editor