আন্টার্কটিকা (Antarctica) মহাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত গৌডিয়ার দ্বীপ। যুক্তরাজ্য থেকে প্রায় ৮ হাজার মাইল দূরে অবস্থিত এই ছোট্ট দ্বীপেই সর্বপ্রথম গড়ে উঠেছিল যুক্তরাজ্যের গবেষণাকেন্দ্র। তবে আদতে এই গবেষণাকেন্দ্র একটি পোস্ট অফিস। বিজ্ঞানীদের কথায় যার পরিচিত ‘পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস’ (Penguin Post Office) নামে।
নামটা শুনে ভ্রূকুঞ্চিত হবে সকলেরই। হঠাৎ এমন আশ্চর্য নাম দেওয়ার কারণ কী এই জায়গার? আসলে এই দ্বীপে রাজত্ব গেন্টু প্রজাতির পেঙ্গুইনের। মূলত গ্রীষ্মকালে এই দ্বীপ হয়ে ওঠে তাদের ব্রিডিং গ্রাউন্ড বা প্রজননকেন্দ্র। ‘পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস’ নামের উৎপত্তিও সেখান থেকেই। একটা সময় শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যের অভিযাত্রী, বিজ্ঞানী এবং গবেষরাই মূলত পরিভ্রমণে আসতেন এই দুর্গম অঞ্চলে। তবে বর্তমানে এই দ্বীপ হয়ে উঠেছে পর্যটকদেরও অন্যতম গন্তব্য।
এই প্রান্তিক অঞ্চলে, যেখানে স্থায়ী বসতি নেই, সেখানে পোস্ট অফিসের কাজ কী? কারা চিঠি পাঠায় এই পোস্ট অফিস থেকে? কেনই-বা হঠাৎ চর্চায় উঠে এল বিশ্বের দক্ষিণতম এই পোস্ট অফিসের নাম?
শেষের প্রশ্নটা দিয়েই শুরু করা যাক। প্রতিবছর এই পোস্ট অফিস পরিচালনার জন্য মনোনয়ন জমা দেন হাজার হাজার গবেষক। অবশ্য শুধু পোস্ট অফিস পরিচালনাই নয়, সেইসঙ্গে তাঁদের কাঁধে দায়িত্ব থাকে গবেষণারও। কয়েক হাজার মনোনয়নপত্রের মধ্যে থেকে মাত্র চার-পাঁচ জন গবেষককে শেষ অবধি ছাড়পত্র দেয় যুক্তরাজ্যের গবেষকমহল। গত বছরেও অন্যথা হয়নি তার। তবে তৈরি হয়েছিল এক নতুন ইতিহাস। বিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী এই পোস্ট অফিস চালনার জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল কেবলমাত্র মহিলা গবেষকদের নিয়ে তৈরি একটি দলকে। দক্ষিণ গোলার্ধের গ্রীষ্মকাল— অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত তাঁরাই দায়িত্ব ছিলেন এই দ্বীপ পর্যবেক্ষণের। তারপর দীর্ঘপথ জাহাজ ও বিমানে চেপে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন তাঁরা। আর সেই প্রেক্ষিতেই নতুন করে চর্চায় উঠে এসেছে ‘পেঙ্গুইন পোস্ট অফিস’।
এবার আসা যাক, এই পোস্ট অফিসের কাজের প্রসঙ্গে। ফিল্ড অপারেশনস কো-অর্ডিনেটর ভিকি ইংলিসের কথায়, এই পোস্ট অফিস পরিচালনার জন্য পোস্টাল স্ট্যাম্পের থেকেও বেশি প্রয়োজনীয় বেলচা। আসলে শুধুমাত্র গ্রীষ্মেই খোলা থাকে এই পোস্ট অফিস। শীতকাল পড়লেই এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যান সমস্ত গবেষক, এমনকি নিকটবর্তী সেনা ছাউনির সৈনিকরাও। ফলে তুষারপাতে ঢাকা পড়ে যায় গোটা দ্বীপটাই। পরের গ্রীষ্মে দ্বীপে নামার পর গবেষকদের প্রথম কাজ হয়, বরফের চাদর খুঁড়ে পোস্ট অফিসের মূল ভবনটি বার করে আনা। আর তার জন্য প্রয়োজন পড়ে বেলচার।
উল্লেখ্য, প্রতিবছর কত ফুট বা কত মিটারের বরফের আস্তরণ পড়ছে এই দ্বীপের ওপর— সেটাও একভাবে কাজে লাগে গবেষণার। চলতি বছরেই যেমন ভিকি ইংলিশ ও তাঁর দল রেকর্ড করেছেন ৪ মিটার তুষারের আস্তরণ পড়েছে এবার। যা নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। পাশাপাশি এই দ্বীপে পেঙ্গুইনরা কতটা নিরাপদে রয়েছে, তাদের সংখ্যা কত, প্রজননের হার— ইত্যাদি পরিসংখ্যান নেওয়া ও আন্টার্কটিকার প্রাকৃতিক গঠন সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহ করাও রয়েছে পোস্টমাস্টারের ‘কাজ’-এর তালিকায়।
এসব ছাড়াও ছোট্ট এই পোস্ট অফিসে রয়েছে আস্ত একটি মিউজিয়াম। চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থাও রয়েছে সেখানে। প্রাচীনকালে এই পোস্ট অফিস ব্যবহার করত মূলত সেনারা। এই পোস্ট অফিস থেকেই সুদূর ব্রিটেনে পাঠানো হত বার্তা। আজ প্রযুক্তির দৌলতে তার প্রয়োজন না-পড়লেও, এই রীতি নস্টালজিয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু মানুষের কাছেই। পর্যটকরা তো বটেই, বহু সেনা আধিকারিকও এই দূরবর্তী দ্বীপ থেকে সৌজন্য চিঠি পাঠান নিজেদের পরিবারে। সবমিলিয়ে বলতে গেলে এ-এক আশ্চর্য জগৎ। তবে প্রতিবছর বাড়তে থাকা পর্যটকদের সংখ্যা, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং দূষণ ইতিমধ্যেই চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে গবেষকদের কপালে। আর কত বছর স্বাভাবিক চেহারা ধরে রাখতে পারবে এই দ্বীপ— তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে প্রতিনিয়ত…
Powered by Froala Editor