আজ থেকে প্রায় ৪৫ বছর আগের কথা। কলকাতা তো বটেই, সারা দেশেই তখনও রক মিউজিকের প্রচলন সেভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু এর মধ্যেই তো কেউ কেউ মানুষের রুচিকে বদলানোর স্বপ্নও দেখেছেন। তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমেই আজ নানা ধরনের পরীক্ষামূলক গানের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। বিশেষ করে গানের দল বা ব্যান্ড গড়ে উঠেছিল রক মিউজিকের সূত্রে। কিন্তু সেইসব পথিকৃৎদের অনেকের কথাই হারিয়ে গিয়েছে সময়ের নিয়মে। তেমনই একজনের নাম প্রবীর চন্দ্র মুখার্জি ওরফে পিসি। আজকের প্রজন্ম তাঁর কথা সেভাবে না জানলেও একটা সময় সারা দেশ মাতিয়ে রেখেছিলেন তিনি। তিনি এবং তাঁর গানের দল, শিবা। হ্যাঁ, দেশের একেবারে প্রথম দিকের রক ব্যান্ডগুলির একটি শিবা, আর তার জন্ম এই কলকাতাতেই।
কলকাতায় বাংলা গানের সংস্কৃতির সঙ্গে রক, পপ বা অন্যান্য নতুন ধারার পাশ্চাত্য সঙ্গীতের চরিত্রগত পার্থক্য তখন অনেক। এইসব বিদেশি গানকে প্রায় অপসংস্কৃতি বলেই মনে করতেন রুচিশীল বাঙালি। তাই বাঙালি পরিবারের কোনো ছেলে রক মিউজিকের কথা বললে পরিবার ভ্রূ কুঁচকে তাকাবে, এটাই স্বাভাবিক। পিসি মুখার্জির জীবনেও তাই হয়েছিল। কিন্তু ততদিনে লিড জেপলিনের গিটারের মূর্ছনা তাঁকে অন্য এক জগতে নিয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে ফিরে আসার আর রাস্তা নেই। অত্যন্ত কম বয়সেই তাই যোগ দিলেন রক ব্যান্ড ‘গ্রেট বিয়ার’-এ। সেটা ৬০-এর দশক। কলকাতায় তখন তেমন বড় কোনো রক ব্যান্ড নেই। গ্রেট বিয়ার-এর মতো ছোট কিছু দল ছিল। তবে তাঁরাও গান রেকর্ডিং-এর জন্য স্টুডিও পেতেন না। অনুষ্ঠান চলত মূলত পার্ক স্ট্রিটের বার এবং পাবে। কোনো দলেরই নিজেদের কোনো গান ছিল না। বিদেশী শিল্পীদের গান পরিবেশন করতেন তাঁরা। তবে গ্রেট বিয়ার ইতিমধ্যে নিজেদের দুটি গান বেঁধেছিল। সিমলায় সেই গান পরিবেশিত হয় ১৯৭০ সালে। পিসি তখন দলের সবচেয়ে দক্ষ গিটারিস্ট।
তবে কিছুদিনের মধ্যেই গ্রেট বিয়ার দল ছাড়লেন পিসি। ১৯৭৪ সালে দল ছড়ার পর দুবছর কোনো কাজ করেননি। ভিতরে ভিতরে চলছিল প্রস্তুতি। এরপর ১৯৭৬ সালে জন্ম নিল শিবা। প্রথম থেকেই গিটারের দায়িত্ব ছিল পিসির উপর। এছাড়া ছিলেন ড্রামার এবং ভোকালিস্ট জেফারি রিখ, বেস গিটারে পম লাহিড়ী এবং কি-বোর্ডে টনি ব্র্যাগানজা। তবে সময় সময় এই লাইন-আপে পরিবর্তন এসেছে। অনেক নতুন শিল্পী দলে যোগ দিয়েছেন, ছেড়েও গিয়েছেন অনেকে। কিন্তু দক্ষ হাতে সমস্ত দলের ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব সামলেছেন পিসি মুখার্জি।
শোনা যায় দলের সদস্যরা অনেক সময় আলোচনা করতেন, যদি ব্যান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হত তবে পিসি মুখার্জি নিঃসন্দেহে সেই তালিকায় মনোনয়ন পেতেন। কারণ আর কিছুই না, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই প্রায় সারা দেশে অনুষ্ঠান শুরু করে শিবা। সদস্যদের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ট্রেনে এবং বাসে চড়ে সারা দেশেই ঘুরে বেড়াতেন তাঁরা। দেশের এমন কোনো রাজ্য নেই, যেখানে শিবার কোনো অনুষ্ঠান হয়নি। এমনকি শহরাঞ্চলের মানুষ সেভাবে রক মিউজিককে আপন করে না নিলেও গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে।
আরও পড়ুন
‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ নামকরণ তাঁরই, প্রয়াত ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রঞ্জন ঘোষাল
১৯৭৬ সালে ব্যান্ডের যাত্রাপথ শুরু হলেও তার রমরমা শুরু হয় মোটামুটি ৮০-র দশক থেকে। ৯০-এর দশকের শুরু পর্যন্ত তার জনপ্রিয়তায় কোথাও ছেদ পড়েনি। কিন্তু এর মধ্যেই হঠাৎ সঙ্গীত জগত থেকে বিদায় নিলেন পিসি মুখার্জি। তাঁর অবসরের পর দল আর বেশিদিন টেকেনি। অমিত দত্ত বা মনোজ দত্তের মতো গিটারিস্ট কিছুদিন দলকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু পিসি মুখার্জির মতো ম্যানেজারের অভাব কেউই পূরণ করতে পারেনি। পিসি মুখার্জির অবসরে সবাই অবাক হয়েছিলেন। তিনি কেরিয়ারে টিকে থাকলে অনেক দূর পর্যন্ত এগোতে পারতেন বলে মনে করতেন অনেকে। বিশেষ করে রক মিউজিকের মূর্ছনায় যখন সমস্ত শ্রোতা মাতোয়ারা হয়ে পড়তেন, তার প্রভাব পড়ত মঞ্চের উপর থাকা শিল্পীদের মধ্যেও – কিন্তু পিসি মুখার্জি তখনও নির্বিকারভাবে গিটারে সুর তুলে যেতেন। এমন নিষ্ঠার তুলনা হয়তো শুধু লিড জেপলিনের মধ্যেই দেখা যেত। তবে কেরিয়ার থেকে অবসর নিলেও নিজের মতো অরে পরীক্ষা চালিয়ে যেতেন পিসি। শেষ দিন পর্যন্ত সঙ্গীত সংস্কৃতির বিষয়ে খবরাখবর নিতেন। কিন্তু এবছর ৪ জুলাই ক্যান্সারে মারা গেলেন পিসি মুখার্জি। আর সেইসঙ্গে শেষ হল সঙ্গীত জগতের এক অধ্যায়। তবে মানুষের রুচির যে বদল এসেছে, তার উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আজকের গানের জগৎ। আর এর পিছনে পিসি মুখার্জি এবং তাঁর দল শিবার ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
২০১৫-তে ভেঙে গিয়েছিল ব্যান্ড, লকডাউনে আবার ‘ফিরল’ পিঙ্ক ফ্লয়েড