“আমি তখন একটি আশ্রমে কাজ করতাম। পড়াশোনা কিছুই হয়নি। কিন্তু আমারও ইচ্ছা হয়েছিল পড়াশোনা করার। মহারাজদের বলেওছিলাম সে-কথা। কিন্তু আশ্রম কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিল না। বলল, আমাদের ঘর পরিষ্কার, বাসন মাজার কাজ কে করবে?” বলছিলেন তারাপদ কাহার। দক্ষিণ কলকাতা পাটুলি দমকলের কাছে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনেই তাঁর ছোট্ট মুদিখানার দোকান। দোকান না বলে তাকে গুমটি বলাই ভালো। কিন্তু তার মধ্যেই এখন সাজানো থরে থরে বই। “আমি অবশ্য এখন আর সেসবের পাতা উলটে দেখতে পারি না। বুকে পেসমেকার বসানো।” কিন্তু নতুন প্রজন্ম যেন শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়, সেটাই লক্ষ্য তারাপদ কাহারের। তাঁর দোকানেই গত ভাষা দিবস থেকে শুরু হয়েছে ওপেন লাইব্রেরি।
“আমার দোকানের উল্টোদিকেই থাকেন শিক্ষক কালীপদ হালদার। তিনিই একদিন এসে বললেন, আমার দোকানে একটা বইয়ের র্যা ক রাখা যাবে কিনা। আমার তো দোকানে জায়গাই নেই। তবুও কোনোভাবে জায়গা করে নেওয়া হল।” জানালেন তারাপদ কাহার। তবে বই জোগাড় করাটাও খুব সহজ ছিল না। মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউটের ইংরেজি শিক্ষক কালীপদ হালদার বলছেন, “করোনা অতিমারী শুরু হতেই দেখলাম সব স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। সেটা তো করতেই হত। কিন্তু স্কুলের বাইরে পড়াশোনাটা তো বন্ধ করা যায় না।” তাঁর কথায়, “শুধু বই পড়লেই হবে না। বই পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে হবে। সাধারণ লাইব্রেরির এতরকম নিয়মকানুনের মধ্যে ছোটোরা সেই আনন্দটা পায় না।” শেষ পর্যন্ত বই কেনার টাকা দেয় কালীপদবাবুর ছোটো ছেলে। স্কুলপড়ুয়া সেই বালকের হাতখরচের টাকা থেকেই কেনা হল ৩০০টি বই। আর কালীপদবাবুর নিজের সংগ্রহের কিছু বইও দিয়ে দিলেন। এভাবেই রাস্তার ধারে গড়ে উঠল আস্ত একটা লাইব্রেরি।
ভাষাদিবসের দিন পথচলা শুরু পাটুলির এই স্ট্রিট লাইব্রেরির। প্রথম দিনই ৫০-৬০ জন ছেলেমেয়ে এসে ভিড় জমিয়েছিল। এখানে বই নেওয়ার জন্য সদস্যপদ নেওয়ার দরকার নেই। শুধু একটি খাতায় তারাপদবাবু লিখে রাখেন কে কোন বই নিয়ে গেল। ফেরত দিয়ে গেলে তাও লিখে রাখা হয়। শুধু বই দেওয়া নেওয়াই নয়, সঙ্গে থাকে গল্প বলার আসর। কোনোদিন আবার অন্য কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এই স্ট্রিট লাইব্রেরি থেকেই দোলপূর্ণিমার সকালে শোভাযাত্রায় সামিল হয়েছিল কচিকাঁচারা। শহরের শিশুদের জীবন থেকে তো এখন আকাশ হারিয়েই যাচ্ছে। সেই আকাশটাকেই যেন ফিরিয়ে আনছেন কালীপদবাবু এবং তারাপদবাবু। একজন শিক্ষক আর একজন তথাকথিত অশিক্ষিত মুদি দোকানি। তবে প্রকৃত শিক্ষার কি সত্যিই এমন কোনো সীমারেখা থাকে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
অষ্টাদশীর স্বপ্নপূরণ, বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে লাইব্রেরি তৈরি রাহিলার