সালটা ১৯৮৬। ঠিক তিন বছর আগেই প্রথমবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতেছিল কপিল দেবের ভারত। কিন্তু তখনও শেষ হয়ে যায়নি ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের টিমটার শক্তি। তখনও খেলছেন ভিভ রিচার্ডস, কোর্টনি ওয়ালস, ম্যালকম মার্শালরা। ওই কিংবদন্তিসম টিম নিয়েই ওই বছর ইংল্যান্ডে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ওই দলেই ছিল জামাইকা থেকে আসা একটি লম্বা চওড়া ছেলে। ডানহাতি ফাস্ট বোলার। কিন্তু তার জায়গা কী করে হবে? অমন সব বিরাট নাম! ছেলেটা আশা ছাড়েনি। নিজের কব্জির জোরের ওপরেই ভরসা রেখেছিল। একসময় সুযোগ এলও, অপ্রত্যাশিতভাবে। মাইকেল হোল্ডিং অনুপস্থিত থাকায় টেস্ট টিমে ঢোকে জামাইকার ছেলেটা। ব্যস, তারপর রান আপের দৌড় শেষ হয়নি আর। ডেবিউ ম্যাচেই ইংল্যান্ডকে একাই ধরাশায়ী করে দেয় সে। হাত থেকে যেন আগুনের গোলা বেরোচ্ছে! সাতটি উইকেট নেয় সেই ম্যাচে। সেই দিন থেকেই বিশ্ব ক্রিকেটে জন্ম নিয়েছিল একটি নতুন নাম। প্যাট্রিক প্যাটারসন…
বাকি সময়টা ছিল রূপকথার। ১৯৮৭-৮৮ সালে ভারতের সঙ্গে ম্যাচেও পাঁচটি উইকেট নেন তিনি। অসম্ভব দ্রুতগতি; সেই সঙ্গে ফাস্ট বোলার সুলভ মেজাজ, আক্রমণ। প্যাটারসনের জন্মই হয়েছিল ২২ গজে আগুন ঝরানোর জন্য। জামাইকার গলিই ছিল তাঁর প্র্যাকটিসের জায়গা। তারপর জামাইকা, ল্যাঙ্কশায়ার, শেফিল্ড শিল্ড, তাসমানিয়ার হয়ে খেলা চলতে থাকে। অবশেষে ওয়েস্ট ইন্ডিজে এসে তাঁর তরী স্থির হয়।
সেই সময় ছিল ক্রিকেটের অন্যতম সেরা সময়। একদিকে ব্যাটে আছেন গাভাস্কার, ভিভ, আজহারউদ্দিন, মিয়াঁদাদরা। অন্যদিকে বল হাতে ওয়াসিম আক্রম, ওয়াকার ইউনিস, ওয়ালসরা। সেখানেই এসে নিজের যোগ্যতায় জায়গা করে নিলেন প্যাটারসন। সেই সময় প্রায় সবারই একটাই স্বীকারোক্তি, প্যাট্রিক ছিলেন প্রতিপক্ষের কাছে ভয়ের অন্য নাম। এমনকি এই উক্তি খোদ তাঁর টিমমেট কিংবদন্তি উইকেটকিপার জেফ্রে ডুজনের। ২৮টি টেস্ট খেলে ৯৩টি উইকেট; প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এই সংখ্যা ৫০০ ছুঁইছুঁই। এমন নামকে অস্বীকার করা যায় কী করে!
কিন্তু গল্পটা লেখা হয়েছিল বোধহয় অন্য ভাবে। যেভাবে এসেছিলেন, সেইরকম উল্কার মতোই তাঁর চলে যাওয়া। ১৯৯২-৯৩ সালের অস্ট্রেলিয়া ট্যুরের পরই দল থেকে বাদ পড়েন প্যাটারসন। সামনে আসে দলে নিয়মভঙ্গের অভিযোগ। ব্যস, তারপর কোথায় যেন হারিয়ে যান তিনি। ওই সময়ের পর ক্রিকেট তো বটেই, গোটা পৃথিবী থেকে যেন প্যাটারসনের অস্তিত্বটাই মুছে গিয়েছিল। কোথায় গেলেন তিনি? আদৌ বেঁচে আছেন কি? নানা প্রশ্ন, নানা জল্পনা তৈরি হতে থাকে মিডিয়ায়।
কেটে যায় ২৫টি বছর। অন্যদিকে একজন ভারতীয় সাংবাদিক খোঁজ চালাতে থাকেন বিশ্বের একসময়ের সবচেয়ে দ্রুত বোলারকে। একদিন পেয়েও যান। হ্যাঁ, বেঁচে আছেন প্যাট্রিক প্যাটারসন। কিন্তু, পুরনো স্মৃতির অনেকটাই হারিয়ে গেছে। খেলার জীবনের কথা সেরকম মনেও থাকে না তাঁর। মনে থাকে না, নাকি চান না সেগুলো ফিরে আসুক? উত্তর নেই। এমসিজি-তে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে দাঁড়িয়ে তাঁদের রীতিমতো শিহরণ জাগানো, নয় উইকেট নেওয়া ভয়ংকর রূপটা যেন কেমন শান্ত হয়ে গেছে। সেই দিনগুলো যে আর ফিরে আসে না।
সেই মানুষটাও যে আর নেই সেরকম। যেন প্রথমবার শুনছেন নিজের কীর্তিগুলো। কিংস্টোনে নিজের বাড়িতেই আছেন। কিন্তু একদম বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ দ্বীপের মতো। মানসিকভাবেও খানিক বিধ্বস্ত। ঝড়ের পর যেরকম সব ছারখার হয়ে যায়, শান্ত হয়ে যায়, সেরকমই হয়ে আছেন বিশ্বের ত্রাস, প্যাট্রিক প্যাটারসন। এভাবেই হারিয়ে যাবেন বলে এসেছিলেন? ওই অল্প সময়ই যা করে গিয়েছিলেন, নিঃসন্দেহে তাঁর কাছ থেকে আরও অনেক ক্রিকেট উপহার পেত সবাই। কিন্তু আজ সেগুলো অতীত। নিজের ভুলে যাওয়া ছায়া হয়েই যেন বেঁচে আছেন প্যাটারসন…