পথের পাঁচালী ও ‘বল্লালী-বালাই’ – যে অমানবিক প্রথার শিকার ইন্দিরা ঠাকরুনও

গ্রীষ্মের এক উত্তপ্ত দুপুর। প্রচণ্ড দাবদাহে সমগ্র প্রকৃতিতে কেমন একটা ঝিমধরা অবসন্ন ভাব। ভাগলপুরের রঘুনন্দন হলের রোয়াকে বসে একটি বাচ্চা মেয়ে একমনে একছড়া তেঁতুল চুষছিল। মেয়েটির ক্লান্ত মায়াবী মুখে দুপুরের সেই ভীষণ রোদ যেন তার সমস্ত স্নেহটুকু নিংড়ে দিচ্ছে।এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক তাড়াহুড়োর মধ্যে যেতে যেতে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।

সেদিনের সেই খরতপ্ত অবসন্ন দুপুরের কাছে বাংলা সাহিত্য চিরকৃতজ্ঞ থাকবে, কারণ সেদিন যদি ওই বাচ্চা মেয়েটি সেই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকটির দৃষ্টি আকর্ষণ না করত, তবে ‘পথের পাঁচালী’র কালজয়ী চরিত্র দুর্গার সৃষ্টিই হত না কোনোদিন। বলাবাহুল্য, সেদিনের সেই মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোকটি ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামীকে বিভূতিভূষণ যে সমস্ত চিঠিপত্র লিখেছিলেন, তার মধ্যে দিয়ে উদঘাটিত হয় এই দুর্গা চরিত্রটির সৃষ্টির রহস্য।

১৯২৯ সালে লেখা হল 'পথের পাঁচালী।' অপু-দুর্গার হাত ধরে কিছুদিনের মধ্যে আপামর বাঙালির কাছে পথের পাঁচালী হয়ে উঠল একটি যাপনের নাম। এর ঠিক পঁচিশ বছর পরে ১৯৫৫ সালে তৈরি হল ‘পথের পাঁচালী’ সিনেমা। তিন বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের পর প্রায় সর্বস্বান্ত সত্যজিৎ স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে বাংলা চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে সৃষ্টি করলেন এক মাইলফলক। যে ছবিতে ইন্দিরা ঠাকরুনের চরিত্রে অভিনয় করেন তৎকালীন কলকাতার পতিতাপল্লীর বাসিন্দা চুনিবালা দেবী।

এই পর্যন্ত ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা। কিন্তু পথের পাঁচালীর প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান পেতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে রাজা বল্লাল সেনের আমলে। ১১৬০-১১৭৯ পর্যন্ত বাংলার বুকে রাজত্ব করেন বল্লাল সেন। এই বল্লাল সেনের হাত ধরেই বাংলার মাটিতে প্রবর্তন হয় কৌলীন্য প্রথার। যদিও রামায়ণেও এই প্রথার খোঁজ মেলে। যে কোনো প্রথার প্রবর্তনের অর্থ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনজাতির জীবনের পরিবর্তন, পরিবর্তন যাপনেরও। কৌলীন্য প্রথার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। যতটুকু জানা যায় তা হল, সমাজ সংস্কারের উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বল্লাল সেন এই প্রথার সূত্রপাত করেন। এই প্রথানুযায়ী প্রতি ছত্রিশ বছর পরে গুণ ও কর্ম অনুযায়ী কুলীন ও অকুলীন নির্বাচন করা হত। কিন্তু লক্ষণ সেন সিংহাসনে বসতেই পরিস্থিতি এক লহমায় আমূল পাল্টে যায়। যে প্রথার উদ্দেশ্য ছিল কুলমর্যাদা রক্ষা করা, সেই প্রথাকে হাতিয়ার করে তৎকালীন বরেন্দ্র এবং রাঢ় বাংলার কুলীন ব্রাহ্মণরা শুরু করলেন বহুবিবাহ। কিছুদিনের মধ্যে বিয়ে একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হল। গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি মেয়ের জীবন হয়ে উঠল দুর্বিষহ।

বাংলার ইতিহাসের এই অন্ধকার দিকটি চোখ এড়িয়ে যায়নি বিভূতিভূষণের। পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকরুন চরিত্রের মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যের পাতায় তুলে আনলেন বাংলার এই কলঙ্কজনক অধ্যায়কে। সেই সময় বাংলার অন্যান্য অনেক মেয়েদের মতো উপন্যাসের ইন্দিরা ঠাকরুন এই কৌলীন্য প্রথার শিকার। সেই জন্যই হরিহরের বাড়িতে বাড়তি বোঝা হয়ে দিন কাটে তার। আর বল্লাল সেন কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তক এই সূত্রেই বিভূতিভূষণ পথের পাঁচালীর একটি অংশের নাম রাখলেন ' বল্লালী-বালাই।' কিন্তু পথের পাঁচালীর হাজার গৌরবজনক ইতিহাস হাজারো আলোর মাঝে বাংলার এই কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের খোঁজ রাখেন কজন?

More From Author See More