কথায় বলে, বাংলার বারো মাসে তেরো পার্বণ। কিন্তু এক পার্বণেরও যে নানারকম রূপ দেখা যায়, সেটা কোনও প্রবাদ স্রষ্টারা বলে যাননি। বর্ধমানের রাজবাড়ি তেমনই একটি জায়গা। দুর্গাপূজায় মণ্ডপে মণ্ডপে মাটির মূর্তি দেখা গেলেও, এই রাজবাড়িতে আজও দেবী পূজিতা হন পটেশ্বরী রূপে; অর্থাৎ পটের ছবি হিসেবে।
প্রায় ৩০০ বছর ধরে বর্ধমান রাজবাড়িতে চলে আসছে এই পটেশ্বরী দেবীর পুজো। শুরুর ইতিহাসটিও বড় অদ্ভুত। দেশে তখন চলছে মারাঠা এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যুদ্ধ। আঁচ পড়েছে বাংলাতেও। তখন বর্ধমানের রাজা ছিলেন ত্রিলোকচন্দ্র। চারিদিকের সংকটজনক পরিস্থিতির মধ্যে বর্ধমান রাজবাড়িতে ঘটে চলেছে একের পর এক দুর্ঘটনা। এমন সময়ই অকালে মারা যান রাজা ত্রিলোকচন্দ্র। রাজপুত্র তেজচাঁদ সিংহাসনে বসলেও, তাঁর উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য রাজপাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন রানী বিষণকুমারী। তখনই এই যাবতীয় বিপদ থেকে বাঁচতে দেবী দুর্গার পূজা করাই স্থির করলেন তিনি। রাজবাড়ির আদি দুর্গামন্দিরে প্রতিষ্ঠিত হলেন দেবী পটেশ্বরী।
কিন্তু মূর্তিপূজা ছেড়ে পটে পূজা কেন? বর্ধমান রাজবাড়ির কুলদেবী হিসেবে আরাধ্যা চণ্ডিকা। কুলপুরোহিত বিধান দিলেন, দুর্গার মূর্তিপূজা অসম্ভব। বরং ছবিতে পূজা করা যেতে পারে। তখন থেকেই সূচনা এই রীতির।
এই পটেশ্বরী দুর্গা আসলে সাড়ে সাত ফুট বাই সাড়ে পাঁচ ফুট ফ্রেমে আঁকা একটা ছবি। কখনও বিসর্জন হয় না এই প্রতিমা। বরং প্রতি ১২ বছর অন্তর প্রতিমার অঙ্গরাগ হয়; অর্থাৎ নতুন করে আবার রং করা হয় ছবিটিতে। রাজবাড়ির পুজো বলে কিছু বিশেষ রীতিও পালিত হয় এখানে। বৈষ্ণব মতে সম্পন্ন করা হয় এই পুজো। আগে সুপারি বলি হলেও, এখন কোনোরকম বলির অনুষ্ঠান হয় না। এই পুজো উপলক্ষে রাজবাড়ির প্রত্যেকে আবার মিলিত হন এক জায়গায়। বিদেশ থেকে সস্ত্রীক আসেন এখনকার রাজা প্রণয়চাঁদ। প্রাচীনকালের সেই জৌলুস, সেই আড়ম্বর আর নেই। সেই রাজপাটও যে নেই আর। আগে পুজো উপলক্ষে মেলা বসত। এখন আর সেটা হয় না। পুজোর জায়গারও পরিবর্তন হয়েছে। এখন লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ মন্দিরে দেবী পটেশ্বরীর পুজো করা হয়। জৌলুস কমে গেলেও, এই ক’টা দিন সবাই একসঙ্গে, নিষ্ঠা ভরে মেতে ওঠেন উৎসবে।