‘তোমাদের শিকড় বাতাসে থেকে যাচ্ছে’— রুমানিয়ার কবি পল সেলানের বিখ্যাত এই উক্তিতেই যেন বাংলাভাগের ক্ষত, স্মৃতির যন্ত্রণাকে সারা পৃথিবীর বাস্তুহারা মানুষের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন বিশিষ্ট লেখক ও প্রাবন্ধিক অভীক চন্দ (Avik Chanda)। ক্যান্টো (Canto Poetry Festival) আন্তর্জাতিক কবিতা উৎসবের পরিচালক তিনি, এই আলোচনাচক্রের সঞ্চালকও। গত শনিবার, ‘ক্যান্টো পোয়েট্রি ফেস্টিভ্যাল’-এর মঞ্চে এই সমন্বয়ের সূত্র খুঁজতে চাইছিলেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যসচিব, বর্তমানে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট আলোচক আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ও (Alapan Bandyopadhyay)। এই দুজনের পাশাপাশি, আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষার অধ্যাপক অ্যালিসন জেমস ও সৃজনশীল রচনা বিভাগের অধ্যাপক লিনা ফেরেরা ক্যাবেজা-ভেনেগাস।
স্বাধীনতা ও দেশভাগ, এক যুগপৎ আশা ও আশাভঙ্গের ইতিহাস। ৭৫ বছর পরেও যে ক্ষত আজও বাঙালি বয়ে চলেছে। আলাপন বলছিলেন, দেশভাগ শুধু ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়। ৭৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা নয়। বরং তার ক্ষত আজও জীবন্ত। তাঁর ভাষায়, “৪৭-এর দেশভাগ আমাদের এক ভাঙনের নেশায় মাতিয়ে তোলে। গতকাল থেকে আজ অবধি আমরা নিজেদের মধ্যে ভিটেমাটি নিয়ে ভাগাভাগির খেলা খেলেই চলেছি। আর এই খেলা ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে গোটা সমাজের শরীরে।”
তবে আলোচনার মূল প্রশ্নটি ছিল ভিন্ন। ৪৭-এর বাংলাভাগ কয়েক লক্ষ মানুষকে জীবনের শিকড় থেকে উপড়ে এনে ফেলেছিল এক সম্পূর্ণ অচেনা, অনভিপ্রেত জীবনের মধ্যে। সারা পৃথিবীতে ইতিহাসের নানা সময়ে, যুদ্ধে, সংঘর্ষে, দাঙ্গায় এভাবেই ভিটেমাটি হারিয়েছেন অগুনতি মানুষ। আজও ইতিহাসের সেই ধারা বয়ে চলেছে। বাংলাভাগের যন্ত্রণা কি কোথাও মিলে যায় সারা বিশ্বের সামগ্রিক সংকটের সঙ্গে? সাহিত্যে, কবিতায় তার অনুরণনই-বা কেমন? আর তাই আলোচনাটির শিরোনাম রাখা হয়েছিল, ‘দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস: ডিপ্রভিন্সিয়ালাইজিং দি পার্টিসান অফ বেঙ্গল’।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে আলাপন পড়ে শোনাচ্ছিলেন, “প্রেমকে ভেঙেছি অতিরিক্ত শরীর মিশিয়ে/ শরীরকে ভেঙেছি আত্মহননের নেশায়।” আর তারই অনুষঙ্গে অভীক চন্দ ফিরে গেলেন উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজের গজলে। তিনিও আর প্রেমের কথা উচ্চারণ করতে পারেন না। কারণ সেই প্রেমকে তিনি ফেলে এসেছেন কোনো এক অগম্য অতীতে, আর অতীত ও বর্তমানের মাঝে বিঁধে রয়েছে কাঁটাতার।
আসলে এই কাঁটাতার তো শুধু দুটো দেশকে আলাদা করে রাখে না। আলাদা করে রাখে আমাদের ইতিহাস আর বর্তমানকে। লিনার কথায়, “বর্তমান সময় বারবার ফিরে যেতে চায় তার অতীতের স্মৃতিতে। কারণ অতীতের স্মৃতিই তার অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। আর অতীতের ক্ষত বিপন্ন করে সেই অস্তিত্বকে।”
বিপন্নতার মাঝেও কবিতা জন্ম নেয়। কারণ সাহিত্যই পারে সেই বিপন্নতার বোধকে সময়ের দলিল করে তুলতে। অ্যালিসনের কথায় তাই উঠে আসে ফরাসি ঔপন্যাসিক জর্জ পেরেসের কথা। জার্মানির হলোকাস্টের সাক্ষী পেরেস। শৈশবের স্মৃতি লিখতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “এই রচনা আসলে তাঁদের (পেরেসের বাবা-মায়ের) মৃত্যুর স্মৃতি এবং আমার জীবনের প্রমাণ।”
ব্যক্তি মানুষের এই স্মৃতি আর তখন ব্যক্তির নিজস্ব স্মৃতি হয়ে থাকে না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে চলতে থাকে তার উত্তরাধিকার। লিনা শোনালেন সেই উত্তরাধিকারের কথা। যুদ্ধবিধ্বস্থ কলোম্বিয়া থেকে ভিটেমাটি হারিয়ে তাঁর পরিবার চলে এসেছিল যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানেই বেড়ে ওঠা তাঁর। সেই যুক্তরাষ্ট্রে বসেই কলোম্বিয়ার যুদ্ধের স্মৃতিকে সংরক্ষণ করতে কলম ধরেছেন তিনি। যুদ্ধের কবিতা অনুবাদ করে পৌঁছে দিচ্ছেন সারা পৃথিবীর পাঠকের কাছে। এই দায়িত্বও উত্তরাধিকার সূত্রেই পেয়েছেন, মনে করেন লিনা।
এভাবেই কথায় কথায় দেশভাগের ক্ষত তার প্রাদেশিক সীমানা পেরিয়ে ক্রমশ আন্তর্জাতিক সংকটের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছিল। তবে সবকিছুই কি মিলে যায়? অমিল নেই কোথাও? সেই প্রশ্নও তুললেন আলাপন। জার্মানির হলোকাস্ট হোক বা কলোম্বিয়ার যুদ্ধ, ভিটেমাটি হারানো মানুষ তাঁদের সমস্ত যন্ত্রণার বিপরীতে আঙুল তুলতে পারেন কোনো একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার দিকে। অথচ বাংলাভাগের নেপথ্যে প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে সমস্ত বাঙালি জাতিই। একশ্রেণির কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, একশ্রেণির বিদ্রোহ এবং সর্বোপরি এই বিরোধকে একটি মিথ্যে সাম্প্রদায়িক চেহারায় হাজির করার ভিতর দিয়ে গড়ে ওঠে দেশভাগের প্রেক্ষাপট। তিলে তিলে প্রত্যেকে সেই প্রেক্ষাপট রচনা করেছেন। আর তাই আলাপন মনে করেন, “দেশভাগ আমাদের সম্মিলিত অপরাধের একটি জান্তব পরিণতি।”
আলাপনের কথার সূত্র ধরে আবার লিনা উল্লেখ করেন আর্ট স্পিগলম্যানের বিখ্যাত গ্রাফিক্স নভেল ‘মাউস’-এর কথা। যে উপন্যাসের প্রসঙ্গে স্পিগলম্যান বলেছিলেন, “আমরা সবাই অপরাধী। একটি অংশের মানুষকে যন্ত্রণার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে বাধ্য না করে আমাদের প্রত্যেকের উচিত অপরাধের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাওয়া।”
অথবা ইতিহাসের প্রতিটি ট্র্যাজেডিই কোথাও গিয়ে এক মিলিত অপরাধের পরিণতি হয়ে ওঠে। প্রতিটি সংঘর্ষই মানুষের সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষ। প্রতিটি সংঘর্ষে মানুষই বিপন্ন হয়। প্রতিটি বিপন্নতা তাই আলাদা হয়েও মিলেমিশে যায়। আর সেই বিপন্নতার স্মৃতি মানুষকে আরও আগ্রাসী করে তোলে। তার ভাষা, ব্যবহার হয়ে ওঠে রুক্ষ। ক্রমশ তা নতুন নতুন সংঘর্ষের সম্ভাবনাকেই প্রসারিত করে। অথচ বিপন্ন সময়েও কবিতার জন্ম হয়। আক্রমণের ভাষা কীভাবে বদলে যায় কবিতার ভাষায়? বিস্ময় প্রকাশ করেন আলাপন। এই বিস্ময়ের কোনো উত্তর হয় না। কারণ জীবনের চেয়ে বড়ো কোনো বিস্ময় নেই পৃথিবীতে।
Powered by Froala Editor