‘প্রয়োজনীয় ছিল দেশভাগ’, পার্টিশন-আর্কাইভে উঠে এল ভিন্ন স্বরও

প্রথম পর্বের পর

ঠাকুরদার কথা শুনে সেইদিন দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে একটাই কথা মনে হয়েছিল, ছোটোবেলায় শেখা একখানা কবিতা—

তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো
তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো!
তার বেলা?

চেয়েছিলাম আরো কিছু জানতে। জানা গেল না। মনে হল, আরো কিছু মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি জানা প্রয়োজন। তার দুটো কারণ। এক, ইন্টারভিউয়ের তথ্য যতটা প্রয়োজন ততটা পাওয়া গেল না। দুই, একরকমের মতামত পেয়ে কোনো তথ্য সম্পূর্ণ হয় না। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস। এই বিশ্বাস এবং প্রয়োজনের দরুন আমার দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে যাওয়া। তিনিও সম্পর্কে আমার দাদুই। আমার মায়ের বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু। শ্রী দ্বিজেন্দ্রলাল ব্যানার্জি (Dwijendralal Banerjee)।

জন্ম ১৯৩৯, বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার এক বর্ধিষ্ণু গ্রামের এক ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণ ও জমিদারি পরিবারে। ১২ জন সন্তানের মধ্যে তিনি পঞ্চম। বাবার নাম শ্রী মুকুন্দলাল বন্দোপাধ্যায় আর মায়ের নাম জিজ্ঞেস করায় তিনি কোনো কারণে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। গ্রামের পাঠশালায় প্রাইমারি স্কুল পাশ করার পরে, স্বাধীনতার বছর তাঁকে পাঠানো হয় নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে, তাঁর পিসির বাড়ি। এই তাঁর প্রথম এই পাড়ে আসা। তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার গুরুত্ব কিংবা মাহাত্ম্য তাঁকে সেইভাবে ছুঁয়ে যায়নি। অন্তত তাঁর কথায়। তবু তিনি এটুকু বুঝেছিলেন, বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যরা কোনো এক কারণে খুব খুশি বা উচ্ছসিত নয়। তাঁর কথায়—

“বাড়ির প্রায় অনেকেই ব্রিটিশের দেওয়া চাকরিতে মোতায়েন ছিলেন। শুধু চাকরি নয়, সুসম্পর্ক ছিল এবং ব্রিটিশের থেকে তাঁরা সময়ে অসময়ে আর্থিক, এবং সামাজিক সাহায্য পেয়েছেন। কৃষকরা সময়ে খাজনা না দিলে ব্রিটিশ পুলিশ সেই খাজনা আদায়ে তাঁদের সাহায্য করেছেন। ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার ফলে তাঁদের বরং স্বস্তির চেয়ে খানিক অস্বস্তি দেখা গিয়েছিল।”

সাতচল্লিশে যখন দেশভাগ (Partition) হয়, তখন আর বাকি পাঁচজনেদের মত দ্বিজেনবাবুর বাবা তাঁর সন্তানদের নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। তবে পার্থক্য এই, বেশিরভাগ মানুষ আসেন পরিস্থিতির শিকার হয়ে, অনিচ্ছায়, জোর করে। আর তাঁর পরিবার আসেন স্বেচ্ছায়। ফরিদপুরের মতই হালিশহরে তাঁর ইচ্ছে ছিল নতুন এক জমিদারি পত্তনের। দ্বিজেনবাবুর কথায়—

আমাদের এই পাড়ে আসার পর, জীবনযাপনের বদল সেই অর্থে ঘটেনি। মোটামুটি স্বচ্ছল অবস্থাতেই থেকেছি বরাবর। এদিকে জমি কিনে সেইজমিতে চাষ, ছেড়ে আসা ফরিদপুরের গ্রাম থেকে নিয়মিত আত্মীয়দের পাঠানো পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা— সেই অর্থে কখনো আমাদের শরণার্থী করে তোলেনি। আমার কাছে ব্যাপারটা অনেকখানি বাসা বদলের ছিল। ওটুকুই দুই দেশে যা পার্থক্য। এছাড়া জীবন প্রায় একই ছিল।

এদেশে আসার পর লোকাল স্কুলে ভর্তি হওয়া, বিমাতার সঙ্গে মনোমালিন্য ক্লাস নাইনে বাড়ি থেকে পালানো, ডানলপ ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ নেওয়া। এই পালিয়ে যাওয়া একটা টার্নিং পয়েন্ট বলা যায়। আমি ওই আরামের জীবনে আর থাকতে চাইনি। সেই সময়ের মানুষের হাহাকার, রক্ত, মৃত্যু, মিথ্যে আমার আরামের জীবনে আঘাত আনছিল। নিজেকে বড়ো দোষী মনে হত। বারবার মনে হত, লড়াই ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে তাঁর এই মনোভাব তাঁকে বাম আদর্শে বিশ্বাসী করে তোলে।

দ্বিজেন্দ্রলাল ব্যানার্জি ও তাঁর স্ত্রী আরতি ব্যানার্জি

 

এরপর ওপার থেকে আসা মানুষের সংখ্যা হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ফলে যখন অন্নসংকট দেখা দেয়, সেসময়ে তিনি চালের বস্তা বিলি করেছেন শিয়ালদহ স্টেশনে। চালের বস্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন শ্রমিকদের কাছে, যাঁরা ওদেশ থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসে আস্তানা গেড়েছিলেন তাঁরই বাড়িতে। এই জেদ দেখে তাঁর কাকার সুপারিশে তিনি ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পান টেলিফোন ভবনে গ্রুপ ডি পোস্টে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক, চারুচন্দ্র কলেজে বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা এবং অবসরে সাহিত্য-থিয়েটারে জড়িয়ে পড়া। স্বপ্ন ছিল বাড়ির সেরেস্তায় নয়, শিক্ষকের চেয়ারে বসবেন। স্বপ্ন সফল হল। বগুলা শ্রী কৃষ্ণ কলেজে যোগ দিলেন ১৯৬৮ সালে। তাঁর আগে বিয়ে করেন স্ত্রী আরতি ব্যানার্জিকে। স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর অনুভূতি কী জিজ্ঞেস করায় তিনি বলেন,

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ পূর্ণ স্বাধীন হয়েছিলাম বলে আমার অন্তত মনে হয় না। ২০০ বছরের শোষিত হওয়ার অভ্যাস একটা কলমের আঁচড়ে পাওয়া যায় না। স্বাধীন হইনি, আমরা ভাগ হয়ে গিয়েছিলাম। The freedom given to us was a hoax which just covered the malicious issue of Partition. They kept alive the theory of divide and rule policy and made us believe that they gave us freedom. My question is with this term, ' given freedom. 'Remember my child, Freedom is not something that's given but earned’...

আরও পড়ুন
দেশের জন্য লড়েও ছাড়তে হয়েছিল ভিটে, দিনাজপুরের ‘অবজ্ঞাত’ স্বাধীনতা সংগ্রামীর গল্প

-    তাহলে কি তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধ, সংগ্রামীদের লড়াই আপনার কাছে অর্থহীন?
-    অর্থহীন নয়। আসলে পরাধীনতার যতখানি বাইরের তার চেয়েও বেশি মনের। সেই মানসিক পরাধীনতার শিকল কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ নয়। মানুষ নিজেকে যতদিন স্বাধীন, নিজে ছাড়া কারুর ওপর নির্ভরশীল নয় ভাবতে পারবে, তবে স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ পাওয়া যাবে।
-    আর দেশভাগ? তার প্রয়োজনীয়তা কতখানি ছিল? ভালো না খারাপ?
-    এবং ভালো-খারাপের প্রশ্নের চেয়েও জরুরি— প্রয়োজনীয়তা, যা আমার মতে ছিল। আবশ্যিক।
-    আপনি এই বিভাজনের রাজনীতি সমর্থন করেন?
-    বিভাজন মনের। প্রাক্টিক্যালি ভাবতে গেলে, সেইসময়ে দেশের যা অবস্থা ছিল সেই অবস্থায় সুষ্ঠুভাবে সবাইকে নিয়ে থাকতে হলে কিছু জায়গা, কিছু আবেগকে বাদ দিতে হত। এক সমুদ্র মানুষ, যারা সদ্য স্বাধীনতা পেয়েছে, যাদের সেই অর্থে পূর্ণ মাত্রায় স্বশাসিত হওয়ার ক্ষমতা নেই, তাদের এই বিভাজন প্রয়োজন ছিল। আর বিভাজন খারাপ কেন? হ্যাঁ, আমায় গৃহহীন হয়ে থাকতে হয়নি, রাতের অন্ধকারে কাঁটাতার টপকে আসতে হয়নি, আধপেটা খেতে হয়নি। যাঁদের হয়েছে তাদের কোনোপ্রকার ছোটো না করেই বলছি, এই কষ্ট কিছুদিনের, কিছু বছরের। শূন্য থেকেও তো শুরু হয়। সুন্দরের শুরু হয়। ছোটো ছোটো ভাবে ভাগ করে দেওয়ার ফলে যদি সবাই সুষ্ঠুভাবে থাকতে পারে, তাহলে ক্ষতি কী? আর আমার মতে এই পার্টিশন না হলে, অন্তত আমার, আমাদের পরিবারের এই জমিদারি পেশাটা ভাঙত না। আমায় হয়ত আজও সেরেস্তায় বসতে হত, হিসেব করতে হত। পার্টিশন সত্যিই লড়াই করে সংগ্রাম করে বাঁচতে শিখিয়েছে। একটি ক্লাসে ছাত্র বেড়ে গেলে ঠিক যে কারণে সেকশান ভাগ করে দেওয়া হয়, আমার অন্তত মনে হয়েছে ঠিক সেরকম কিছু কারণের জন্যেই, যাতে সুদূরপ্রসারী কিছু উন্নতি করা যায়, যাতে আগামী দিনের দিকে তাকিয়ে কিছু ভালো হয়— সে-জন্যেই এক বিভাজন। হ্যাঁ ধর্মীয় কারণ, মুনাফা ভিত্তিক রাজনৈতিক কারণ অবশ্যই রয়েছে, হয়তো এগুলোই প্রধান কারণ কিন্তু এই কারণগুলোকে সরিয়ে যদি দুই দেশেরই ভালো কী কী হয়েছে তার হিসেব করা যায়, তাহলে কিন্তু আজকের দিনে তাকিয়ে এই পার্টিশনকে ক্ষতিকারক না বলাই বোধহয় শ্রেয়। আর তোমাদের ইতিহাসের কথায়, Cultural assimilation, amalgamation-এরও তো প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। আজকে এপার-ওপার মিলেমিশে যেটুকু নতুন তৈরি হয়েছে, তাকেই বা অস্বীকার করি কী করে! তাই আমি অন্তত মনে মনে পার্টিশনকে প্রাথমিকভাবে নেতিবাচক চোখে দেখলেও অন্তর থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই বিচার করি। কারণ এটাই সত্য। ধ্রুব সত্য।

দেশভাগ নিয়ে এরকম অনুভূতি খানিক বিরল। এরই মধ্যে উঠে আসে ফরিদপুরের বাড়ির কথা, আত্মীয়-বন্ধুদের কথা, তুলসীতলার কথা। এসব কিছু তিনি আর পরবর্তী জীবনে ঘেঁটে দেখতে চাননি। যা গেছে তা গেছে। হয়ত সেসব গেছে বলেই আজ এই জায়গায় তিনি। তিনি শেষ করেছিলেন সেই অমোঘ কথা শুনিয়ে—

‘মনেরে আজি কহ যে/ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যের লও সহজে।’
(চলবে)

আরও পড়ুন
বঙ্কিমচন্দ্রের কলমেই রূপ পান ‘ভারতমাতা’, অবনীন্দ্রনাথ তুলিতে ধরলেন তাঁকে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
যাত্রা শুরু: পার্টিশন-আর্কাইভ ও এক ইতিহাস-ছাত্রীর শিকড়ের খোঁজ