প্রথম পর্ব
"আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি..."
কিংবা,
"বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল
পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, পুণ্য হউক হে ভগবান..."
এই 'বাংলা' বলতে ঠিক কী বোঝায়, সেই দ্বন্দ্বের দোলাচলে ছোটবেলায়, যখন 'ইতিহাস' বলতে কেবল রাজা-রানি আর 'রাজনীতি' কেবল বড়োদের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ থাকত, প্রশ্ন ছিল তবে থেকে। তখন শেখানো হয়েছিল, রাজ্যের নাম 'পশ্চিমবঙ্গ' বা West Bengal। অথচ ঘরে টাঙানো ভারতের মানচিত্র উল্টো কথা বলে। আর শুনতাম, মায়ের বাবার বাড়ির দিক নাকি 'বাঙাল'। বাঙাল কী? কেন? মা বাঙালি নয়? প্রশ্ন জাগলেও, প্রশ্ন করিনি।
বুঝিনি তখন, "প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা..."
তবুও বড়ো হওয়ার হাওয়া গায়ে লাগতে, ইতিহাসের গণ্ডিতে রাজারানি বাদ দিয়ে মন্ত্রী-মজুরের সম্পর্কের ধারণা কিঞ্চিৎ হতে, ইতিহাস ও ঐতিহাসিকের পারস্পরিক সম্পর্কের সমীকরণের আন্দাজ হতে বুঝতে পারলাম, উত্তরগুলো সহজ বলেই হয়তো কেউ সেইভাবে আজও দেখেও দেখে না। কিংবা, দেখানো হয় না। কারণ—
"ঘরে-বাইরে উদাহরণ যা আছে
তা ক্ষুধাহরণের সুধা ক্ষরণের উদাহরণ নয়
তা সুধাহরণের ক্ষুধাভরণের উদাহরণ।"
এই স্রোত বয়ে যখন পশ্চিমবঙ্গের নামকরণের কারণ খুঁজে পেলাম সেসময়ে 'পূর্ববঙ্গ' নামক এক জায়গায় সঙ্গে পরিচিতি শুরু। মানচিত্রে চিনেছি ভূগোলের ক্লাসে। এবার চেনা ইতিহাসের ঘাঁটতে চাওয়া এক ছাত্রীর চোখে। পড়ার বই পেরিয়ে কৌতূহল পৌঁছাল কবিতায়, গল্পে। জেনেছি, আমরা যাকে 'দেশ' বলি, অনেকেই তাকে 'দ্যাশ' বলে। ম্যামের কাছে শোনা হয়ে গিয়েছে, যেভাবে পরিযায়ী পাখিরা যেমন বাসা বদলে আরামের জায়গায় আসে হাজার মাইল উড়ে, ঠিক তেমনই হেঁটে হেঁটে মানুষ বাসা, আশ্রয়, খাদ্যের খোঁজে এসেছিল। এসেছিল, এর চাইতে বলা ভালো আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। তফাৎ, পাখিরা ঠান্ডার কবল থেকে বাঁচতে উড়ে আসে, আর নিশ্চিন্তে ফিরে যায়। আর এরা ফিরে যেতে পারেনি। এদের আসা সদ্য রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানের শিকার হয়ে। শীতল কিছু মানুষের ইচ্ছার দরুন।
এই 'নাগরিক হত্যামঞ্চের' ইতিহাস খুঁড়তে গিয়ে দেখি এর ভিন্ন স্তর। কেউ বলে, দেশভাগের (Partition) সিদ্ধান্ত একেবারেই সঠিক। যুগোপযোগী। কেউ-বা বলে— ‘এ ক্ষতের ও ক্ষতির হিসেব বাইশের সাতের মতো’, মিলবে না, মিলতে পারে না..."
কোনো ঘটনা, ভুল-ঠিকের বিচার একজন ইতিহাসের ছাত্রীর কর্তব্য নয়। তার কর্তব্য অনুভূতিকে বাদ দিয়ে, ফ্যাক্ট কিংবা ঘটনাকে উপস্থাপন করা। এই উপস্থাপনা আরো হাতে কলমে শিখতে আমার যোগাযোগ ১৯৪৭ পার্টিশন আর্কাইভের সঙ্গে। স্ট্যান্ডফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কাইভাল লাইব্রেরির ওরাল হিস্টোরিয়ান হওয়ার সুবাদে। এঁদের সঙ্গে পরিচয় না হলে বোধহয় জানাই হত না, ভারত, একটি থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিতে, পঁচাত্তর বছর আগে ঘটে যাওয়া পার্টিশন বা দেশভাগ নিয়ে তাঁরা ঠিক কতখানি চিন্তিত। তাঁরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে যাঁরা এই দেশভাগের যন্ত্রণা ভোগ করেছেন বা করানো হয়েছে, যাঁরা তাঁদের কৈশোরে কিংবা শৈশবে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণা ভোগ করেছেন, কিংবা না করলেও দেখেছেন, প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থেকেছেন, তাঁদের সেইসব স্মৃতি ধরে রাখা যায়। ভিডিওর বা অডিও ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে।
সেই এক কাজ নিয়েই আমার এ-যাত্রা শুরু।
কার ইন্টারভিউ নেব, এই ভাবনাতে কাটে বেশ কিছুদিন। জানব যাঁদের থেকে তাঁরা সবাই ষাটোর্ধ্ব তো বটেই, বাহাত্তুরে ধরেছে বললেও কম বলাই হয়। এঁদের মধ্যেও যাঁদের শারীরিক মানসিক অবস্থা খানিক ঠিক, তাঁদের কিছুজন আজও এই বিষয়ে বাইরে লোক, ক্যামেরার সামনে মুখ খুলতে দ্বিধা করেন, ভয় পান।
প্রথমে উপস্থিত হই আমার ঠাকুরদার কাছে। পূর্ব মেদিনীপুরে। কাঁথি ও দীঘার মধ্যে অবস্থিত এক গ্রাম, নস্করপুর। না, আমার ঠাকুরদা ওপার থেকে এসে এইদিকে বাড়ি করেননি। জন্মসূত্রেই তিনি সেখানের। ভাবনা ছিল, যাঁরা ওপর থেকে এসেছেন তাঁদের চোখে স্বাধীনতা, দেশভাগ কেমন সে-চিত্র আমাদের অনেকেরই জানা। ইচ্ছে ছিল, যাঁরা একটু অন্যদিকের তাঁদের ওপর প্রভাব কেমন। হয়েছিল, কতখানি সেই যন্ত্রণা ছুঁয়ে গিয়েছিল তাঁদের, এ-ব্যথা কতখানি সমব্যথী করে তুলতে পেরেছিল, জানতে প্রশ্ন করি তাঁকে।
বয়স একানব্বই। পেশায় প্রাইমারি শিক্ষক। নাম— শ্রী কেশব চন্দ্র দাস। ঠাকুরদা অল্প বয়সে গান্ধীর গা ঘেঁসে থাকতেন বলে শুনেছি বাবার কাছে। ঘরে চরকা কেটে সুতো তৈরি করা এবং আজ অব্দি হাঁটুর নিচে ধুতি পরতে তাকে দেখা যায় না। জেলে গিয়েছিলেন অল্প বয়সে বেশ কবার ব্রিটিশ পুলিশের কাছে মার খেয়ে। জিজ্ঞেস করি— "স্বাধীনতা নিয়ে তোমার স্মৃতি কী?"
ঠাকুরদা উত্তর দেন, স্বাধীনতা যখন ঘোষণা হয় তখনো চারদিক উত্তপ্ত। পুলিশ বাহিনী গ্রাম থেকে সরে গেল, রেডিওতে ঘোষণা হল। শুনলাম স্বাধীন হয়েছি। তবে স্বাধীনতা কী, বুঝতে সময় লেগেছে। অবস্থার পরিবর্তন হয়নি দ্রুত। না খেতে পাওয়ার অবস্থা, ফি বছরের বন্যা বা খরা— এই পরিস্থিতির বদল হতে সময় লাগে।"
— “আর দেশভাগ?"
আরও পড়ুন
দেশভাগে ছাড়তে হয়েছিল বাড়ি, ৭৫ বছর পর জন্মভিটেয় পা রাখার অনুমতি পেলেন বৃদ্ধা
উত্তর আসে, “এদিকে দেশভাগের সেরকম ছবি কিংবা প্রভাব দেখা যায়নি। কোলাঘাটকে সীমানা ধরে নেওয়া যেতে পারে এই ক্ষেত্রে। কোলাঘাট অব্দি শোনা গেছিল বেশ কিছু মানুষ সেইদিক থেকে এসেছেন। কিন্তু মেদিনীপুরের দিকে প্রভাব সেই অর্থে নেই বললেই চলে। আর আমারও তখন কলকাতার দিকে যাওয়ার চল ছিল না, তাই ভিটেমাটি ছেড়ে আসাদের যন্ত্রণা আমি চাক্ষুষ করিনি। রেডিওতে শোনা আর খবরের কাগজে ছবি, লেখা। তবে এ যন্ত্রণা ভুলব না কখনও। পরে দেখেছি, কী নির্মম ভাবে অত্যাচারিত হয়েছিলেন তাঁরা। মৃত্যু, হিংসা, ধর্ষণ, খুন, লুট, দাঙ্গা— কিচ্ছু বাদ রাখেনি। কাদের জন্যে দেশভাগ? সাধারণ মানুষের ভালোর জন্যে? এই যদি ভালোর নমুনা হয়ে থাকে, তাহলে এমন ভালোর দরকার নেই। দরকার ছিল না।
ধর্মীয়, শুধুমাত্র ধর্মের মতো এক ঠুনকো কারণে যারা দেশভাগ করে বাচ্চা ছেলেদের খেলার দল ভাগ করার মতো, তারা আজ যাই হোক কখনো হিতৈষী নয়। আর কীসের ভাগ? মায়ের থেকে সন্তানকে যে বা যারা আলাদা করেছে তারা আর যাই হোক দেশের ভালো চায় এ-কথা ঠিক বিশ্বাস আজকেও হয় না। দেশ শাসনের দোহাই দিয়ে যারা দ্বেষ সৃষ্টি করে, তারা গণতান্ত্রিক দেশে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে গোড়াতেই ব্যর্থ... আর রইল পরে ভাগের কথা। তাকিয়ে দ্যাখ, ওই এক টুকরো জমিতে (দালানের বাইরে চাষ জমির দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে) যতই ভাগ বসুক না কেন, মাটি যেখানে এক, যেইখানে একই আলো খেলা করে, একই হাওয়া ফসলের গায়ে লাগে, সেখানে দাগ দিয়ে যত টুকরো করাই হোক না কেন, ফসল, ফসলের সৌন্দর্য আলাদা হয় না। এ ভাগ কাল্পনিক। ব্যবসায়িক।"
আর কিছু বলেননি। জানেন না, এমন নয়। জানেন। বললেন না। দায়িত্ব দিলেন, বাকি আরো মতামত জোগাড়ের।
(চলবে)
আরও পড়ুন
৭৪ বছর পর পুনর্মিলন, দেশভাগে ‘হারিয়ে’ যাওয়া ভাইকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন বৃদ্ধ
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
দেশভাগের পর শরণার্থীদের পাশে বিমান কোম্পানি; নেপথ্যে কেরালার উদ্যোগপতি