'দুই বিঘা জমি' কবিতায় রবীন্দ্রনাথ শৈশবের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লিখেছিলেন চৈত্রের ভোরে আম কুড়োনোর কথা। তবে আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে বড়ো হয়েছি, তখন অনেকেরই আম কুড়নোর সুযোগ ছিল না। আমাদের স্মৃতিতে তাই থেকে গিয়েছে হলদে-সবুজ মোড়কে মাত্র এক টাকার পাকা আম। আসলে একটা লজেন্স। পার্লে ম্যাঙ্গো বাইট। বেশি কিছু বায়না তো ছিল না, কিছু খুচরো কয়েন হাতে পেলেই ছুটতাম দোকানের দিকে। আর স্বাধীনতা দিবস বা রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানেও কচিকাঁচাদের আটকে রাখার অব্যর্থ অস্ত্র ছিল এই লজেন্স। আজ আর হয়তো সেই আকর্ষণ নেই, কিন্তু বাজারে এখনও পাওয়া যায় সেই এক স্বাদের ম্যাঙ্গো বাইট।
১৯৮৯ সাল থেকে এই লজেন্স ছোটোদের হতে তুলে দিয়ে আসছে পার্লে কোম্পানি। অন্তত দুটি দশকের সমস্ত ছোটোদের মধ্যেই প্রবল জনপ্রিয় ছিল এই লজেন্স। অবশ্য এক সময় এই লজেন্সের বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও গড়িয়েছিল। এতে নাকি ল্যাকটিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি। আর তাই স্বাস্থ্যের জন্য খুব একটা ভালো নয়। সেটা ২০১২ সাল। এই মামলার জন্যই হোক, বা বদলে যাওয়া শৈশবের কারণে, এখন আর কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের শেষে ক্ষুদে দর্শকদের হাতে এই লজেন্স তুলে দিতে দেখা যায় না। ছোটোরাও এখন অন্যকিছুর জন্য বায়না করে। তবে এখনও দুই সপ্তাহে অন্তত ২ কোটি লজেন্স বিক্রি হয় বলে জানাচ্ছেন কোম্পানির আধিকারিকরা।
পার্লে কোম্পানির যাত্রা কিন্তু আরও পুরনো। সেই ১৯২৯ সালে যখন ব্রিটিশ শক্তিকে দেশ থেকে তাড়িয়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে ভারতবর্ষ, আর এক এক করে গড়ে উঠছে স্বদেশি কারখানা; তখনই মুম্বইয়ের কাছে খান্দেকর মার্গে বেকারির কারখানা গড়ে তুলল চৌহান পরিবার। এই পরিবারের বাস ছিল পার্লে ভিল গ্রামে। সেই থেকে কারখানার নাম পার্লে। সেই থেকে দেশের বাজার মাত করে রেখেছে কোম্পানি। ম্যাঙ্গো বাইটের মতোই আরেক কিংবদন্তি হয়ে থেকে গিয়েছে পার্লে-জি বিস্কুট। এছাড়াও 'হাইড অ্যান্ড সিক' বিস্কুট, একলায়ার্স লজেন্স এবং অসংখ্য জনপ্রিয় কেক তো আছেই। এসবের কোনোটার বয়স ৩০ বছর, কোনটার তারও বেশি। কিন্তু স্থায়ী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী আজও দেখা দেয়নি।
শুধু ভারতেই নয়, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও পার্লে ম্যাঙ্গো বাইট যথেষ্ট জনপ্রিয় বলেই জানাচ্ছে কোম্পানি। এমনকি পৃথিবীর বৃহত্তম বিস্কুট বিক্রেতার সম্মানও পেয়েছে এই কোম্পানি। কিন্তু ছোটো-বড়ো অনেক কোম্পানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এখন বাজার কিছুটা নিম্নমুখী। বর্তমান মালিক বিজয় চৌহানের স্মৃতিতে তাই নিশ্চই এখনও উজ্জ্বল হয়ে আছে গত শতাব্দীর শেষ বছরগুলোর কথা। যদিও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পার্লে এখন বড় কর্পোরেট ব্যবসার দিকেই ঝুঁকছে। কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে এক টাকার সামান্য লজেন্স। আজকের কচিকাঁচারাও আর এইসব সামান্য জিনিসের জন্য বায়না করে কি?
তবে কিছুদিন আগেই নোটবন্দির সময় হঠাৎ আবার বাজার দখল করেছিল এই লজেন্স। দুহাজার টাকার নোটের ধাক্কায় হঠাৎ বাজার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল খুচরো কয়েন। আর তাই দোকানে বাজারে রেজগি নিয়ে বেশ মন কষাকষি চলত খরিদ্দার এবং বিক্রেতার। তবে সেই মন কষাকষির শেষেও ছিল এক মধুর উপহার। খুচরো নেই তো কী হয়েছে? ম্যাঙ্গো বাইট নিয়ে যান। সেদিন নিশ্চিত ছোটবেলার সেই নস্টালজিয়ার কাছে অনেকের রাগ হার মেনেছিল।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
আর কারও গোলামি নয়; মাস্টারদার সঙ্গী বিপ্লবী সুরেশ দে প্রতিষ্ঠা করলেন ‘শ্রীলেদার্স’