৬০ লক্ষাধিক মানুষের দেহাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে প্যারিস নগরী!

এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে লম্বা এক সুড়ঙ্গ। আর তার চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের হাড়। অবশ্য অবিন্যস্তভাবে নয়, সুড়ঙ্গের দেওয়াল-ছাদ এমনকি মাঝের প্রকাণ্ড স্তম্ভগুলিতেও বেশ যত্ন নিয়ে পরিপাটি করে সাজানো মানবকঙ্কাল। সেইসঙ্গে নিভু নিভু হলুদ আলো আরও ‘ভৌতিক’ করে তুলেছে গোটা অঞ্চলটাকে। যেন এই সুড়ঙ্গ সাক্ষাৎ বিদেশি হরর সিনেমার কোনো প্রেক্ষাপট! কিন্তু কোথায় এই মৃত্যুপুরী?

প্যারিস শহর (Paris)। ঠিকানাটা শুনলে খানিকটা চমকে গেলেন নিশ্চয়ই? হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। বিশ্বের অন্যতম সুন্দর মহানগরী তথা আইফেল টাওয়ারের দেশেই রয়েছে এমনই এক ভয়ঙ্কর গণ-সমাধিক্ষেত্র। যা বিস্তৃত গোটা শহরজুড়েই। তবে বাইরে থেকে দর্শন মেলে না তার। এই দৃশ্য চাক্ষুষ করতে ঢুকে পড়তে হবে প্যারিসের পেটের ভিতর। ভূগর্ভে। কিন্তু মাটির তলায় এমন সুড়ঙ্গ খনন করে সমাধিক্ষেত্র তৈরির কারণ কী? 

সেই গল্পের হদিশ পেতে ফিরে যেতে হবে কয়েক শতক। এই গণকবরের জন্ম হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে। যদিও এই সুড়ঙ্গ নির্মিত হয়েছিল তারও প্রায় পাঁচশো বছর আগে। ত্রয়োদশ শতকেই বিশ্বের অন্যতম জনপদ হয়ে ফ্রান্সের প্যারিস নগরী। শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গড়ে উঠেছিল আধুনিক সভ্যতা। আর তার অন্যতম কারণ ছিল, প্যারিসের নিচে জমে থাকা প্রাকৃতিক খনিজের ভাণ্ডার। সেই খনিজ উত্তোলনের জন্যই খোঁড়া হয়েছিল এইসব সুড়ঙ্গ। তবে উত্তরোত্তর খনিজের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায়, তিনশো বছরের মধ্যেই ফুরিয়ে যায় প্যারিসের খনিজ ভাণ্ডার। পরিত্যক্ত হয়ে ওঠে সুড়ঙ্গগুলি। 

এবার শ’খানেক বছর এগিয়ে চলে আসা যাক সপ্তদশ শতকে। সেসময় থেকে এক অদ্ভুত সমস্যার সম্মুখীন হয় প্যারিস নগরী। প্যারিসের জনসংখ্যা কম ছিল না কোনোকালেই। তার ওপর প্যারিস শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠায়, সেসময় গোটা ইউরোপ থেকেই কাজের আশায় প্যারিসে ভিড় জমাতেন মানুষ। ফলে দ্রুত গতিতে বাড়ছিল নাগরিকদের সংখ্যা। স্বাভাবিকভাবেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মৃত্যুর সংখ্যাও। আর তাতেই উপচে ওঠে শহরের সমাধিক্ষেত্রগুলি। 

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: প্যারিস তাঁকে গড়েছে, করেছে বিভ্রান্তও

অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে, তৎকালীন প্যারিসের সর্ববৃহৎ সমাধিক্ষেত্র লা ইনোসেন্ট গির্জার সেমেটারিতে গণসমাধির ব্যবস্থা করা হয়। এক-একটি গর্ত খুঁড়ে তাতে সমাধিস্থ করা হত প্রায় দেড় হাজার মানুষকে। তবে সেই ‘সুবিধা’ পেতেও গুনতে হত মোটা অঙ্কের টাকা। আর যে-সকল পরিবারের সামর্থ্য নেই, খোলা আকাশের নিচে স্তূপাকারে জমে থাকত তাঁদের প্রিয়জনদের মৃতদেহ। গির্জার কয়েক মাইল দূর থেকেও টের পাওয়া যেত মানবদেহ পচনের সেই দুর্গন্ধ। বিষয়টিতে প্যারিস প্রশাসন হস্তক্ষেপ করতে চাইলেও, লাভের কারণে সায় দেয়নি গির্জা কর্তৃপক্ষ। 

আরও পড়ুন
উদয় প্যারিসে ফিরছেন তাঁর নিজের তৈরি দল নিয়ে

এর মধ্যে ঘটে যায় আরও একটা ভয়াবহ ঘটনা। ১৭৮০ সালে ভয়াবহ বৃষ্টি ও বন্যায় ভেঙে পড়ে লা ইনোসেন্ট সেমেটারির প্রাচীর। বন্যার জলে ভেসে পচা-গলা মৃতদেহ ছড়িয়ে পড়ে গোটা শহরে। শহরের হাল ফেরাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেন রাজা ষোড়শ লুইস। সিদ্ধান্ত নেন লা ইনোসেন্টের সমাধিস্থল খুঁড়ে সমস্ত মানুষের দেহাবশেষই বার করে আনা হবে। আর তাদের নতুন ঠিকানা হবে প্যারিস শহরের সেই পরিত্যক্ত সুড়ঙ্গে। 

আরও পড়ুন
গলে যাচ্ছে আস্ত বাড়ি! প্যারিসের ‘মেল্টিং হাউস’ দেখে থ গোটা বিশ্ব

তবে খুব কিছু সহজ ছিল না সেই কাজ। হাজার হাজার শ্রমিকের দীর্ঘ ১২ বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর প্যারিসে সমাধিস্থ সমস্ত মানুষের দেহাবশেষই সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুড়ঙ্গে। প্যারিসের পর পার্শ্ববর্তী শহর থেকেও সমাধিস্থ মানুষেরদের দেহ তুলে আনা হয় প্যারিসের সুড়ঙ্গে। ১৮১৪ পর্যন্ত চলে সেই কর্মযজ্ঞ। সবমিলিয়ে আনুমানিক ৬০-৭০ লক্ষ মানুষের দেহাবশেষ লুকিয়ে রয়েছে এই সুড়ঙ্গে। ভূপৃষ্ঠের প্রায় ২০ মিটার নিচে শায়িত এই সুড়ঙ্গের জন্য ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমাও পেয়েছে প্যারিস।

১৮০৯ সালে প্রদর্শনীর জন্য খুলে দেওয়া হয় সুড়ঙ্গের একটি বিশেষ অংশ। সেই অংশটি নিপুণভাবে সাজানো হয়েছিল মানুষের অস্থি দিয়েই। ২০০২ সালে ‘ক্যাটাকম্ব’ (Paris Catacombs) খ্যাত এই সুড়ঙ্গটিকে জুড়ে দেওয়া হয় প্যারিসের খ্যাতনামা কার্নাভালেট জাদুঘরের সঙ্গে। টিকিট কেটেই ঘুরে আসা যায় এই মৃত্যুপুরীতে। তবে দুর্নামও খুব একটা কম নয়। এই ‘হাড়ের সুড়ঙ্গ’-এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাড় হিম করা ভয়ঙ্কর সব ভূতুড়ে ঘটনার কাহিনিও। অবশ্য সেসব তোয়াক্কা করে এই পাতালপুরী একবার প্রবেশ করতে পারলে বিস্ময়ের অবকাশ থাকে না এতটুকুও…

Powered by Froala Editor