১৯৫৫ সালের একটি গ্রীষ্মের দিনে একটি ভাঙাচোরা দুধ বিক্রির ভ্যানে করে শুরু হয়েছিল যাত্রা। যাত্রী তিনজন। তিনজনই তিন মেরুর বাসিন্দা। হেনরি আন্যাভাইল, একজন ফরাসি। কলিন গ্লিনি, খাঁটি ইংরেজ। দেবেন ভট্টাচার্য, বেনারসের পুণ্যভূমিতে বড় হওয়া ব্রাহ্মণসন্তান। তিনজন ভিন্ন মেরুর হলেও একটা মিল ছিল এঁদের। তিনজনই ছিলেন সুর পাগল। এই যাত্রার উদ্দেশ্যও ছিল তাই – ক্যাপচারিং দ্য সাউন্ড অফ দ্য ওয়ার্ল্ড।
শুরু হল যাত্রা। পরবর্তী ৬ মাস ছিল অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ। যুগোস্লাভিয়া, গ্রিস, তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান টপকে ভারত। অবশেষে কলকাতা। প্যারিস থেকে কলকাতা। ১৯,০০০ কিলোমিটারের এই যাত্রাপথে তৈরি হল ‘প্যারিস টু ক্যালকাটা: মেন অ্যান্ড মিউজিক অন দ্য ডেজার্ট রোড’, একটি কাব্যিক ভ্রমণকাহিনী। আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষজন থেকে শুরু করে মরুভূমির বেদুইন এসবই ধরে রেখেছিল তাঁদের ক্যামেরা ও টেপ রেকর্ডার।
বেনারসে বড় হওয়া এই মানুষটির মন ছোটো থেকেই পুলকিত হয়ে উঠেছিল মন্দিরের ঘণ্টা, মন্ত্রচ্চারণ আর ঢাকের তালে। এই শ্রুতি বৈচিত্র্য তাঁর মনকে গভীর ভাবে আবিষ্ট করেছিল। কিশোর বয়সে লুইস থমসনের কবিতায় প্রভাবিত হয়েছিলেন দেবেন। কাজ করেছিলেন বিবিসি রেডিও প্রডিউসার হিসেবেও। ফলত, হাতের কাছে পেয়েছিলেন নানা ধারার গান, সুর। এর প্রভাবেই আরো সুর নিবিষ্ট হয়ে পরেন দেবেন।
তাঁর তৈরি এই চল্লিশ ঘণ্টার মিউজিক রিলিজ হয় ১৯৫৬ সালে। ‘এল পি মিউজিক অন দ্য ডেজার্ট রোড: এ সাউন্ড ট্রাভেলগ’।
শুধুই সুর নয়, দেবেন লিখেছিলেন ট্র্যাভেল ডাইরিও। যাত্রাপথের মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের ব্যক্তিজীবনের গল্প থেকে শুরু করে তাদের বাঁধা গানও। আরো নানা মিউজিক প্রজেক্টের ভিড়ে তা হারিয়ে যায়। পরবর্তীতে তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা ভট্টাচার্য ও সঙ্গীতপ্রেমী রবার্ট মিলিসের উদ্যোগে ২০১৮ সালে সাব লাইম রেকর্ডস থেকে প্রকাশিত হয় ‘প্যারিস টু ক্যালকাটা: মেন অ্যান্ড মিউজিক অন দ্য ডেজার্ট রোড’। শুকনো মরুভূমিতে বেদুইনদের তৈরি কফির ঘ্রাণ থেকে শুরু করে ঠাকুরের ভজন পর্যন্ত সবই ছিল তাতে।
২০০১ সালে মারা যান দেবেন ভট্টাচার্য। স্রষ্টা চলে গেলেন। সৃষ্টি অমর করল তাঁকে।