শিল্পের আর যে কোনো মাধ্যমের মতই একটি ছবিকে পড়ার ক্ষেত্রেও নানারকম ‘অভিমুখ’ থাকে – কোনো নির্দিষ্ট একটি লেখায় সম্ভাব্য অনেকগুলি অভিমুখ থেকে আমরা একটিকে বেছে নিই। ইন্দ্রাশিস আচার্য্য পরিচালিত ‘পার্সেল’ ছবি নিয়ে কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবে যে দিকটি সামনে উঠে আসে, তা হল অ্যাডাপ্টেশন – সাহিত্যের কোনো গল্প বা উপন্যাস নয়, বরং অ্যাডাপ্টেশন নিজের মাধ্যমেরই, অন্য একটি ছবির। সিনেফিলিয়া জগতে বিখ্যাত, ইউরোপীয়ান বর্ষীয়ান চলচ্চিত্র নির্মাতা মাইকেল হ্যানেকে’র ২০০৫ সালের ছবি ‘ক্যাশে’ কে নিজের ভাষায় এবং সংস্কৃতিতে অ্যাডাপ্ট করার চেষ্টা করেছেন ইন্দ্রাশিস, যা আমার মতে অত্যন্ত জরুরি একটি প্রচেষ্টা। গল্প-উপন্যাস থেকে ছবি হওয়াটা প্রচলিত, স্বাভাবিক একটি পন্থা, কিন্তু অন্য ছবি থেকে ‘রিমেক’ না করে অ্যাডাপ্ট করাটা চলচ্চিত্রপাঠের নানান সম্ভাবনা খুলে দেয়। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, একটি চলচ্চিত্র থেকেই আরেকটি চলচ্চিত্র অ্যাডাপটেশন (আবারও বলছি, রিমেক নয়) অত্যন্ত জরুরি এবং কার্যকরী একটি পন্থা – বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসে এহেন উদাহরণ কম নেই। তাই ‘পার্সেল’ সাময়িক ভাবে থিয়েটারে মুক্তি পাওয়ার পর অনেকেই যাঁরা চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তুলেছিলেন, বলতে দ্বিধা নেই, দাবিটি হাস্যকর। শিল্পকর্মে একশো শতাংশ মৌলিক বলে কোনো জিনিস হয় না, তাই বলে, না বলে ‘অ্যাডাপ্টেশন’-এর খেলা সবসময়েই চলতে থাকে। অরিজিনালিটি শিল্প বিচারে খুব একটা জরুরি কোনো মানদণ্ড নয়, তাই আমার কাছে ‘পার্সেল’ আরও বেশি আগ্রহজনক ‘ক্যাশে’ ছবিটির সঙ্গে আত্মীয়তা আছে বলেই।
কিন্তু ‘রিভিউ’-র স্বল্প পরিসরে এইধরণের প্রস্তাবিত পাঠের সম্ভাব্য জটিলতা এবং বহুমুখীনতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হবে না বলেই আমি শুধু এই পথটি নেব না। বরং, বাংলা সিনেমার এই মরা বাজারে পার্সেলের মত ছবি ‘রিফ্রেশিং’ – অন্তত যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা চলচ্চিত্র মাধ্যমের প্রাথমিক কিছু দিক – ‘ক্রাফট’ – তাতে একধরণের দখল নিয়ে কাজ করতে নেমেছেন – এই আশ্বাসটুকুই বাংলা সিনেমার প্রেক্ষিতে যথেষ্ট, কারণ শিল্প নির্মাণের এই সামান্য দিকটিই আমাদের সমকালীন ছবি থেকে উধাও হয়ে গেছে। তাই, আমি অ্যাডাপ্টেশন সংক্রান্ত কিছু জরুরি কথা যা না বললেই নয়, তা দিয়ে আলোচনা শুরু করে এই ছবিটির গঠনগত, ‘ফর্ম্যাল’ দক্ষতার কিছু দিক আলোচনা করব। গড্ডালিকা প্রবাহই যখন সত্য হয় তখন দক্ষ কাজে দক্ষতার দিক গুলোই আলাদা করে দেখিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, না হলে বাজারভর্তি মুড়িতে মিছরিকেও মুড়ি বলেই মনে হয়।
ক্যাশে ছবির অ্যাডাপ্টেশন হিসেবে ‘পার্সেল’ একই সঙ্গে সফল এবং ততটাও সফল নয় – এই অনুভব হয়, তার প্রধাণ কারণ একদিকে, ‘ক্যাশে’র মত ছবির জটিলতা এবং অভিঘাত বাংলা সিনেমার সমকালীন ধারা থেকে বহুদিন স্রেফ লুপ্ত; পার্সেল একটি দক্ষ প্রচেষ্টা। আবার আরেকদিকে, ‘ক্যাশে’ ছবিটিকে ছাড়া ‘পার্সেল’ নিয়ে ভাবতে পারা যায় না বলেই ‘ক্যাশে’ যেভাবে দর্শককে তীব্র আক্রমণ করে, ছবির শেষে একচুল রেহাই থাকে না – সেই তীব্রতার মান ‘পার্সেল’এ সেভাবে নেই। কিন্তু তাও – ‘ক্যাশে’র সঙ্গে আত্মীয়তার জন্যই বাংলা সিনেমার সাপেক্ষে পার্সেল ‘জরুরি’ – কারণ দর্শককে আঘাত করতে চাওয়ার এই প্রচেষ্টাটুকুও বাংলা বাজারে চট করে দেখা যায় না। খানিক বিশদে বলা যাক।
ঐতিহাসিক ভাবে, ষাটের দশকের সময় থেকেই পৃথিবীর নানান জায়গায় মূলধারার সিনেমাও যেভাবে ইউরোপিয়ান মর্ডানিস্ট ঘরানার ভাববিশ্বে দর্শককে স্বস্তি না দিয়ে আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিল; বাংলা বা ভারতীয় ছবির ধারায় সেই চর্চা বেশ অপ্রতুল। দর্শককে একটি ‘ফিল গুড’ পরিসরে সুখী সুখী এন্টারটেনমেন্ট দেওয়ার বিপ্রতীপে প্রচলিত সামাজিক বিশ্বাস এবং দর্শকের মূল্যবোধ, রাজনীতিকে আক্রমণ করা যে কোনো শিল্প মাধ্যমেরই একটি নৈতিক কর্তব্য। বাংলা ছবির সাপেক্ষে ঋত্বিক ঘটক (মেঘে ঢাকা তারা, সুবর্ণরেখা) বা সত্যজিৎ রায় (জন অরণ্য) কখনও এরকম চেষ্টা করেছেন বটে, তবে নব্বই দশকের পর থেকে বাংলার সাধের ‘আর্ট ফিল্ম’ প্রায় সযত্নে এ জাতীয় নাশকতা চালানো থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। তারা ক্যামেরা আর সাউন্ড রেকর্ডার নিয়ে উচ্চমধ্যবিত্ত দাম্পত্যকলহে সেঁদিয়ে সেই যে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করেছে, তা সমকালীন ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড বয়দের ছবিতে এখনও চলছে। ইন্দ্রাশিসের ছবি সে দিক থেকে আশ্চর্য ব্যতিক্রম, কারণ তিনিও তাঁর ছবির প্রধান চরিত্রে মধ্যবিত্ত একটি পরিবারকে রাখলেও – সেই পরিবারের প্রতি জায়গা বিশেষে সহানুভূতিশীল হলেও – তিনি ওঁদের ঠাট্টা করেন, লুকিয়ে রাখা অপরাধের বোঝা বের করে নিয়ে আসতে চান, প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করেন। আমার অন্তত মনে পড়ছে না, শেষ কবে সমকালীন পরিচিত, বিখ্যাত নির্মাতাদের বাংলা ছবি দেখেছি, যেখানে চলচ্চিত্রের একটি প্রাথমিক বিষয় - প্রধান চরিত্রদের ‘ক্রিটিকালি’ দেখা হচ্ছে। এবং সেই সুত্র ধরেই, দর্শককে বিরক্ত করা হচ্ছে, অস্বস্তি দেওয়া হচ্ছে, শান্তি দিচ্ছে না। অবশ্যই ‘ক্যাশে’র সঙ্গে আত্মীয়তা বশতই ইন্দ্রাশিস এই দক্ষতা অর্জন করেন; তবুও এখানে ওঁকে প্রাপ্র্য প্রশংসা করতেই হয় – ‘বেনি’স ভিডিও’, ‘হোয়াইট রিবন’ ‘ক্যাশে’র মত ছবি তো নব্বই দশক থেকে হচ্ছে, (দুএকটি ব্যতিক্রম ছাড়া) বাকিরা তো সাউথ কলকাতার ক্যাফে আর পরকিয়া ছেড়ে বেরোতে পারলেন না।
এর সঙ্গে সঙ্গেই – পার্সেলের আরেকটি গুরুত্ব, যা ‘ক্যাশে’ ছাপিয়ে ইন্দ্রাশিসের নিজের কৃতিত্ব – তা হল মূল গল্পের আধারেই ছোটো ছোটো গল্প লুকিয়ে রাখা – সময়বিশেষে যে গল্প এসে মূল গল্পকে হন্ট করে যায়। ছবি জুড়ে আমরা দেখি, প্রধান মধ্যবিত্ত দম্পতির নানা গোপন গল্প আছে – কোথাও প্রেম, কোথাও অনৈতিক বিচ্ছেদ বা বন্ধুর সর্বনাশ করার অপরাধবোধ, কোথাও নিজের পরিবারেরই গ্রামে থাকা আত্মীয়দের অসুস্থতার খবর কিছুদিনের জন্য স্রেফ ভুলে যাওয়া। রাজনৈতিক ছবির পলিটিকাল কারেক্টনেসের বিপরীতে পার্সেলের এও খানিক জরুরি অর্জন – মুখের উপর স্লোগান করে সব কথা বলে না দিয়ে কথা লুকিয়ে রাখা, যা কিনা দিনের শেষে আরও অভিঘাতপূর্ণ, আরও অস্বস্তিকর, তুলনামূলক নাশকতাসুভ হয়ে ওঠে।
শেষ করার আগে শুরুতেই বলে রাখা গঠনগত, ‘ফর্ম্যাল’ কিছু দক্ষতার কথা বলে আপতত ইতি টানব। ইন্দ্রাশিসের তিনটি ছবিই দেখার সুবাদে বলতে পারি, ক্রাফটের উপর ওঁর দখল ক্রমবর্ধমান – ছবিগুলো ক্রমান্বয়ে আরও সুসংবদ্ধ, এ অত্যন্ত আশার কথা। ছবির কাঠামোয় তাকে ধরে রাখার জন্য কিছু কিছু এলিমেন্ট লাগে, যা বারবার ছবিতে নির্দিষ্ট সময়ে ফিরে ফিরে এসে ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা তৈরি করে, যাকে পরিভাষায় ‘মোটিফ’ বলে। এ ছবির শব্দে ‘ডোরবেল’ বা ‘ফোনের রিংটোন’ বারবার মোটিফের মত ফিরে ফিরে আসে (অবশ্যই এক্ষেত্রে শব্দনির্মাতা সুকান্ত মজুমদারের কাজ প্রশংশনীয়) – ইমেজে দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার কাঁপা কাঁপা হ্যান্ডহেল্ড শট সেই একই কাজ করে। ছবি জুড়ে মিঁজসিন নির্মাণে নির্মাতাদের কনসিস্টেন্সি এবং তার পিছনের শ্রমকে পড়ে নিতে পারা যায়, বোঝা যায় – যাঁরা কাজ করেছেন তাঁরা দক্ষ। আগেও বলেছি, বাংলা সিনেমার মরা বাজারে এ-গুণ অত্যন্ত জরুরি, কারণ ছবি বানাবার প্রাথমিক উপাদানগুলোতে দক্ষতার নিদর্শনই লুপ্তপ্রায় হতে চলেছে।
তাই পরিশেষে দর্শকের উদ্দেশ্যে অনুরোধ থাকবে – ছবিটি দেখুন, লকডাউনের আগে সাময়িকভাবে থিয়েটারে মুক্তি পেয়ে প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়, এর পরে কী হবে আমরা তা জানি না। কিন্তু যেভাবেই সুযোগ আসুক না কেন – ছবিটি দেখা দরকার। শিল্প হিসেবে যোগ্য, ছবি হিসেবে সার্থকতার জন্য তো বটেই, আর খানিকটা সর্বসময়ের ‘ফিল গুড’ পরিসরের বাইরে বেরিয়ে খানিক বিরক্ত হওয়ার জন্য, অস্বস্তিতে পড়ার জন্যও বটে। কখনওই নিজেকে বিরক্ত হতে না দিলে মস্তিষ্কে জং ধরে যায়, আর ভাবা প্র্যাকটিস করা যায় না।
Powered by Froala Editor