কথা বলেন আর মাত্র ৫০ জন, মৃত্যুর পথে পাপুয়া নিউ গিনির আদিমতম ভাষা

২০০০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। আর এই শতকের শেষে সেই সংখ্যাটাই অর্ধেক হয়ে যাবে বলেই অনুমান বিশেষজ্ঞদের। অর্থাৎ, প্রতি দু’সপ্তাহেই মৃত্যু ঘটে চলেছে একটি করে ভাষার। অথচ আমরা কতটাই বা ওয়াকিবহাল তার সম্পর্কে? কে-ই বা খোঁজ রাখি কোন ভাষা হারিয়ে গেল পৃথিবী থেকে চিরতরে?

‘আ ডেথ ইন দ্য রেন ফরেস্ট: হাউ আ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড আ ওয়ে ওফ লাইফ কেম টু এন এন্ড ইন পাপুয়া নিউ গিনি’। ২০১৯ সালে এমনই একটি বই প্রকাশ করেছিলেন ভাষাবিদ ডন কুলিক। একটি ভাষার মৃত্যু পথযাত্রার উদাহরণ দিয়েই তুলে ধরেছিলেন বাস্তব পরিস্থিতিকে। 

পাপুয়া নিউ গিনির দুর্গম চিরসবুজ অরণ্যের মধ্যে ছোট্ট একটি গ্রাম গাপুন। সেখানেই বসবাস জনা পঞ্চাশেক মানুষের। আর গাপুয়ান জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই কথা বলে এক প্রাচীন ভাষায়— ‘তায়াপ’-এ (বা তাইপ)। বহুদিন আগেই তায়াপ সংযোজিত হয়েছিল বিলুপ্তপ্রায় ভাষার তালিকায়। নৃতত্ত্ববিদরা জানিয়েছিলেন ক্রমে হ্রাস পেতে থাকা জনসংখ্যার কারণেই মুছে যাবে এই ভাষা। তবে কার্যত অন্য কারণে আরও দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এই আদিমতম ভাষা তায়াপ। হয়তো তার আর অস্তিত্ব টিকে থাকবে চার থেকে পাঁচ দশক।

কিন্তু এর কারণ কী? নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাবিদ ডন কুলিকের পর্যবেক্ষণে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরেই নিউ গিনির সেপিক প্রদেশের গাপুনে সময় কাটিয়েছেন কুলিক। শিখেছেন তায়াপ ভাষা। এই ৩৫ বছর সময়ে খুব কাছ থেকে মিশেছেন প্রায় ২০০ জন গাপুয়ানদের সঙ্গে। হয়ে উঠেছিলেন তাঁদেরই একজন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কুলিক জানান, এর পিছনে আসলে রয়েছে বর্হিবিশ্বেরই হাত। ভাষার মৃত্যুর বহু আগে থেকেই গাপুয়ান সংস্কৃতি এবং জীবনযাত্রার ইতিহাস এবং ঐতিহ্যই ফুরিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। নিজের বইতে এমনটাই জানাচ্ছেন কুলিক। 

পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় দেড় শতক। উনিশ শতাব্দী থেকেই ঔপনিবেশিক শাসনের আওতায় আসে পাপুয়া ও নিউ গিনি। প্রথমে জার্মানি, পরে কিছু অংশে অস্ট্রেলিয়া, জাপান এবং ব্রিটেন আধিপত্য বিস্তার এই দ্বীপ-দেশে। স্বেতাঙ্গদের আগমনের পর থেকেই ধীরে ধীরে শুরু হয় পুরনো সংস্কৃতির ছন্দপতন। বিংশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই নিউ গিনি-তে গড়ে ওঠে একাধিক খ্রিস্টান মিশনারি। আর এই প্রগতিশীলতার জন্যই দরকার পরে ঠিকাদারী শ্রমিকদের, কৃষিকর্মীদের। তখন থেকেই নিজেদের গ্রাম ছেড়ে গাপুয়ানরা চলে যেতে শুরু করে গড়ে ওঠা নতুন শহরগুলোয়। আর সেইসঙ্গে পুরনো জীবনযাপন মুছে নতুন অভ্যাস গড়ে ওঠে জীবন-জীবিকার।

তবে শ্বেতাঙ্গদের প্রভাব এখানেই শেষ নয়। গাপুনে মূলত তাঁরা জীবন নির্ধারণ করতেন বনভূমির ওপর নির্ভর করেই। কিন্তু জ্বালানি কাঠের প্রয়োজনে সেই অরণ্য নিধন শুরু করেন ঔপনিবেশিকরা। ফাঁকা হয়ে যেতে থাকে একরের পর একর জমি। গাপুয়ানদের কাছে শেষ অবধি বেঁচে থাকে মাত্র দুটি পথ। প্রথমটি ভিন্ন সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া। আর যাঁরা এই পথে যেতে পারলেন না তাঁরা বেকারত্বের শিকার হয়ে অনেকেই বেছে নিলেন চুরি, ছিনতাই, দস্যুবৃত্তিকে। কেউ আবার শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে বেছে নিচ্ছেন মাফিয়া চক্রকে।

আরও পড়ুন
সাংবাদিকতাকে হাতিয়ার করেই আদিবাসী মহিলাদের জন্যে লড়াই ওড়িশার জয়ন্তীর

১৯৭৫ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে পাপুয়া নিউ গিনি। কিন্তু তাতেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন হয় না তাঁদের। কারণ দেশের মূল ক্ষমতা থেকে যায় মূলত ‘বহিরাগত’দের হাতেই। তাঁরাই তো এ দেশে এসে স্থায়ী বসতি গড়েছেন। কারখানা, শহর, ব্যবসা— সব ক্ষেত্রেই যে তাঁদেরই একচেটিয়া আধিপত্য, ক্ষমতা। 

কুলিকের লেখা বইটি পড়লেই বোঝা যায়, গাপুয়ানদের মধ্যে স্থায়ী ধারণা হয়ে গেছে শ্বেতাঙ্গ হতে পারলেই আসলে আয়ত্ত করা যায় এই ক্ষমতা। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির হাত ধরলেই হয়তো বজায় রাখা যায় নিজেদের স্ট্যাটাস। আর উপার্জন তো বটেই। ফলে অনেকেই বিবাহ করে চলে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী গ্রামে। কেউ কেউ চাকরির সন্ধানে বাধ্য হয়েই শহরে গিয়ে শিখছেন বহুল প্রচলিত ও সরকারি ভাষা ‘তোক পিসিন’। 

তায়াপ ভাষা গাপুয়ানরা মূলত আয়ত্ত করতেন তাঁদের পূর্বসূরিদের থেকে। শুনে শুনেই শিখতেন এই ভাষা। সংস্কৃতি, গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার ফলে তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই আর ভাষার সেই রেশ সঞ্চারিত হচ্ছে না। মাতৃভাষার জায়গায় তারা ছোট থেকেই শিখছে ‘তোক পিসিন’।

আরও পড়ুন
ঋতুকালীন কিশোরীদের স্বাস্থ্যবিধির পাঠ দিচ্ছেন আদিবাসী মহিলারাই

কুলিক দীর্ঘদিন ধরে গাপুয়ানদের ভাষা শিখেছেন। তৈরি করেছেন একটি শব্দকোষও। সংরক্ষণ করেছেন এই ভাষার ব্যাকরণকেও। কিন্তু তারপরেও তাঁর বিবৃতি অনুযায়ী তায়াপ ভাষায় তিনি স্বাচ্ছন্দে কথা বলতে পারেন না। কারণ, তায়াপ ভাষার বুনিয়াদ বহু পুরনো, তাই অন্য ভাষার মতো সাধারণ নয় তার উচ্চারণ। সেইসঙ্গে ভাষায় ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন শব্দ, ফলি। একমাত্র তায়েপ ভাষাগোষ্ঠীর কোনো মানুষ ছাড়া অন্যদের পক্ষে আয়ত্ত করা যা দুঃসাধ্যই।

কমতে কমতে জনগোষ্ঠীর সদস্যদের বর্তমান সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫০-এর কম। আর সেক্ষেত্রেও ধীরে ধীরে বাড়ছে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রবণতা। বাড়ছে গড় বয়সও। যাঁরা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা-প্রৌঢ় রয়েছেন, তাঁদের ভরসাতেই যেন টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছে তায়েপ। তারপরই তাকে ছেড়ে যেতে হবে এই পৃথিবী। ডকুমেন্টেশন থাকলেও, তাকে বাস্তবায়িত করা অসম্ভবই।

স্বাধীনতার পর ইতিমধ্যেই পাপুয়া নিউ গিনি থেকে হারিয়ে গেছে ১১টি এমন প্রাচীন ভাষা। কিন্তু তারপরেও আদি ভূমিপুত্রদের সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তেমন কিছুই ভাবেনি সরকার। ভাবেনি চিরসবুজ অরণ্যরক্ষা, উপার্জনের রাস্তা করে দেওয়ার কথাও। আরও একটা ভাষার মৃত্যু হলে সেই দায়টা তারা নেবে তো? জানা নেই উত্তর।

আরও পড়ুন
আদিবাসীদের দাবি মেনে ঐতিহ্যে বদল, এবার দশেরায় কাটা পড়বে না একটিও গাছ

কিছুদিন আগেই আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ থেকে এমনভাবেই মুছে গেছে সারে ভাষা। ২০০৪ সালে মুছে গিয়েছিল আদিবাসী ভাষা ‘বো’-ও। ক্রমাগত বেড়ে চলেছে পৃথিবীর জনসংখ্যা। আর তার উল্টোদিকে কমছে ভাষার সংখ্যা। হারিয়ে যাচ্ছে বৈচিত্র। এভাবেই একটা একটা করে রং ঝরে পড়ার পর সত্যিই আর রামধনু রং থাকবে তো ভাষা জগতে? তার উত্তরই অসহায়ভাবে খুঁজে চলেছেন কুলিক। চেষ্টা করে চলেছেন প্রশাসনকে সচেতন করতে। কিন্তু আদৌ কি সকলে ওয়াকিবহাল হতে পারছেন নিজেদের মাতৃভাষার ব্যাপারে। প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে রইল সেখানেই। এভাবে চলতে থাকলে বাংলার বিভিন্ন উপভাষাগুলিরও লালতালিকায় জায়গা হলে খুব কি অবাক হবেন? 

Powered by Froala Editor

More From Author See More