কাগজের মণ্ড পাকিয়ে তৈরি ছোটো ছোটো সব বাক্স। আর তার ওপরে রং-তুলি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা নানারকমের ছবি। কোনোটা নিছক নকশা। কোনোটায় আবার ফুটে উঠেছে পাহাড়ের কোলে সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য। সারা ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা এমনই সব বাক্স, যাদের বলা হয় পাপিয়ার-মাশে (Papier-Mache)। সারাদিন বসে সেইসব বাক্সের গায়ে ছবি এঁকে চলেছেন দুই ভাই ও তাঁদের দুই স্ত্রী। সেই ৩ বছর বয়সে হাতে তুলি তুলে নিয়েছিলেন কাশ্মীরের (Kashmir) শিল্পী মকবুল জান। তাঁর ভাই ফিরদৌসও ছোটো থেকেই ছবি আঁকতে পটু। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই কাজই তো করে চলেছেন তাঁরা। ঠিক কবে থেকে কাশ্মীরের পাপিয়ার-মাশে শিল্পের শুরু, জানেন না কেউই। শুধু আশঙ্কা করেন, আর বেশিদিন হয়তো এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
সম্ভবত হিমালয় উপত্যকায় তুর্কি আক্রমণের পরেই শুরু হয়েছিল পাপিয়ার-মাশে শিল্প। আর তাই এর মধ্যে ইসলামিক শিল্পকলার সুস্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। সেইসঙ্গে মধ্যযুগের ভারতীয় শিল্পকলারও মিশ্রণ ঘটেছিল। মোঘল যুগেই পাপিয়ার-মাশে শিল্পের বিকাশ হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। সেই ঐতিহাসিক শিল্প আজ রীতিমতো ধুঁকছে। একসময় শ্রীনগরের আশেপাশে প্রায় সমস্ত বাড়িতেই কাগজের বাক্সের উপর ছবি আঁকার চল ছিল। আর তার চাহিদাও তো কম ছিল না। তবে বর্তমানে সরকারিভাবে সংখ্যাটা নেমে এসেছে ১ লক্ষেরও নিচে। তাঁদের মধ্যে অবশ্য অধিকাংশই নিয়মিত চর্চার মধ্যে থাকেন না। সেই অর্থে এখন পাপিয়ার-মাশে শিল্পীর সংখ্যা বড়োজোর ৩ হাজার। তরুণ প্রজন্মের প্রায় কেউই আর এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চান না। ২০০৮ সালে ইউনেস্কোর তরফ থেকে সিল অফ এক্সসেলেন্স সম্মান পেয়েছিলেন মকবুল জান। তাঁর দুই ছেলের কেউই আর এই পেশায় আগ্রহী নন। আর তার সবচেয়ে বড়ো কারণ, শিল্পী হিসাবে নূন্যতম সম্মানটুকুও পান না তাঁরা।
কাশ্মীরের পাপিয়ার-মাশে শিল্পীদের নিয়ে অনেকেরই ধারনা, তাঁরা ভীষণ গরিব। আর তাই এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে চাই আর্থিক সাহায্য। অর্থনীতিকে বাদ দিয়ে কোনো শিল্পই টিকে থাকতে পারে না, এ-কথা সত্যি। কিন্তু তার চেয়েও বেশি করে প্রয়োজন শিল্পীর সম্মান। এমনটাই মত পাপিয়ার-মাশে শিল্পীদের। একসময় তাও পর্যটকদের কাছে চাহিদা ছিল এইসব শিল্পের। কিন্তু একের পর এক ঘটনায় সেই চাহিদাও এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। ৯০-এর দশক থেকেই কাশ্মীরে বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে শুরু করে। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান এবং চিনের সামরিক সংঘর্ষ তো লেগেই আছে। ফলে পর্যটকের সংখ্যা এখন রীতিমতো কমে এসেছে। আর বিদেশে বিপণনের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্তভোগীদের প্রতারণাও নিত্যদিনের সঙ্গী। সব মিলিয়ে রীতিমতো ধুঁকছে ঐতিহাসিক এই শিল্প। এর মধ্যেই গতবছর প্রথমবার হস্তশিল্প সংরক্ষনের বিষয়ে সরকারি নীতি গ্রহণ করেছে কাশ্মীর সরকার। কিন্তু এর পরেও কি বাঁচানো যাবে পাপিয়ার-মাশে শিল্পকে? শিল্পীদের মন থেকে সংশয় এখনও দূর হতে চায় না।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
শেষ মুহূর্তের বায়নায় হিমশিম খাচ্ছে বর্ধমানের 'শোলা শিল্পগ্রাম'