‘বঙ্গাল কে শের’। অমলজ্যোতি ঘোষকে এ-নামটা দেন বড়ে গোলাম আলি। তখন অমলজ্যোতি ঘোষ পান্নালাল ঘোষ নামেই খ্যাত। পান্নালাল ঘোষ সেই মানুষ, যিনি ভারতের রাগ সঙ্গীতে যে বাঁশি বাজানো যায় – তা দেখান। ওঁর বাঁশিপ্রাপ্তি নিয়ে বাংলায় বহু মিথ প্রচলিত। কেউ বলেন, জন্মস্থান বরিশালের নদীতে একটা বাঁশি পান তিনি। কেউ বলেন, কোনো এক সাধু শ্মশানে বাঁশি আর শঙ্খ পছন্দ করতে বললে তিনি বাঁশিই পছন্দ করেন। সেখানেই নাকি ভবিষ্যৎ লেখা হয় এই মর্মে যে, তিনি বিরাট শিল্পী হবেন। সে যাই হোক, বাঁশিটা তিনি শেষজীবন অবধি বয়ে বেড়ালেন। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের আসর থেকে নৌশাদের মুঘল-এ–আজম অবধি।
ছোটো থেকে কী কী শিখলেন পান্নালাল - কণ্ঠসঙ্গীত, সেতার, পাখোয়াজ,তবলা, বাঁশি, বক্সিং, জিমন্যাস্টিক। স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে তৎকালীন হুজুরদের রক্তচক্ষুর ফলে সতেরো বছর বয়েসে এলেন কলকাতায়। কলকাতায় এসে চাকরি নিলেন একবার একটা টিউবয়েলের কোম্পানিতে, কখনো একটা প্রেসে। তখনও সিনেমার মুখে বোল ফোটেনি। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে কনসার্ট বাজানোর চল ছিল স্টেজের পেছনে। পান্নালাল বাঁশি বাজাবার কাজ পেলেন। তখনো তাঁর স্বমহিমায় আসার বেশ খানিকটা দেরি আছে। তিনি অনুভব করলেন, শুধু সঙ্গত করে পেট ভরলেও মন ভরছে না। তিনি রাগ সঙ্গীত বাজানোর তালিম শুরু করলেন - তিনবছর টানা চললও। ইতোমধ্যে তাঁর বাবা অক্ষয়কুমার ঘোষ, যিনি কিনা সেনিয়াঘরের সেতারি ও পান্নালালের সেতারের গুরুও বটে - তিনি চলে গেলেন।
অন্যদিকে, এর মধ্যেই পান্নালাল সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশলেন। শুধু যে মিশলেন তাই নয়, ব্যায়াম শেখানোর বিনিময়ে শিখলেন ধনুর্বিদ্যা। আর পেলেন সাধারণের তুলনায় যথেষ্ট লম্বা বাঁশি, যার আওয়াজের গভীরতা ওঁকে ভীষণ টাচ করে। ডায়মন্ডহারবার থেকে বাঁশ জোগাড় করে একজন খেলনাওয়ালার সঙ্গে মিলে বাঁশি বানালেন নিজের মতো করে, যার দৈর্ঘ্য বত্রিশ ইঞ্চি।
এবার আমাদের ১৯৩৪ সালের দিকে একবার ফিরে তাকাতে হবে। সে-বছর অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্সের উদ্বোধন করলেন রবীন্দ্রনাথ। সে-প্রতিযোগিতায় নিয়ম ছিল যে প্রথম হবে, সে পরের বছর অনুষ্ঠান করার ডাক পাবে। পান্নালাল প্রথম হলেন। অনেকের মধ্যে ছিলেন বিচারক হিসেবে বাবা আলাউদ্দিন। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে ১৯৪৬ সালে একদিন সরাসরি শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। আলাউদ্দিন প্রাথমিক অনিচ্ছের পর দেড় বছর শেখালেন পান্নালাল ঘোষকে।
পঁয়ত্রিশ বছরের পান্নালাল ততদিনে বোম্বে গিয়ে কাজও করেছেন। বাঁশির জনপ্রিয়তা দেখে ওঁর ছাত্রই ওঁকে বোম্বে যাওয়ার জন্যে বলেন। বিবাহও করেন প্রখ্যাত সুরকার, যিনি কিনা পান্নালালের বাল্যবন্ধু ও সুরসঙ্গী, অনিল বিশ্বাসের বোন শিল্পী পারুল বিশ্বাসকে।
পান্নালাল ঘোষ সম্পর্কে একটা গুজব ওঠে যে, দুটো আঙুলের মধ্যেকার যে গ্যাপ, সেটা নাকি অপারেশান করে বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। যদিও সেটা ভিত্তিহীন। পান্নালাল ঘোষ যেখানে মেধার পরিচয় দিলেন সেটা হল, পান্নালাল ওঁর উদ্ভাবন দিয়ে যে বাঁশিটা বানালেন, সেটাতে একটা এক্সটা ছিদ্র জুড়ে দিলেন। শোনা যায়, তাতে বেহাগ, ইমন, বাগেশ্রীর মতো রাগের ক্ষেত্রে মীড়ের জায়গাটা আরো একটু স্বচ্ছন্দ হয়েছিল। তিনি পরবর্তীতে ছয় তারের তানপুরাও প্রচলন করেন। যদিও অনেকে এ-ব্যাপারে ওঁকে কৃতিত্ব দিয়ে কুণ্ঠা করেন।
এতকিছুর মধ্যে ১৯৩৮ সাল নাগাদ তাঁর ইউরোপ ট্যুর হয়ে গেছে। যা সে সময়ের নিরিখে বিরাট ও বিরল। পান্নালাল ঘোষের জীবন দেখলে একটা কথা বোঝা যায়, তিনি একটা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, বাঁশিকে সম্বল করে। নিয়মিত চর্চা করে, পথ তৈরি করে, পথ বদল করে একটা শেপ দিতে চেয়েছিলেন হয়তো বাঁশিকে। হয়তো বাঁশি না পেলে তাঁর বাবার শেখানো যন্ত্র সেতারের মধ্যে তাঁকে পেত শ্রোতারা। তাতে একজন রবিশঙ্কর, একজন বিলায়েত খানের পাশে হয়তো তিনি স্বমেধায় বসতেন। কিন্তু বাঁশিটাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রসার করে পান্নালাল দেখালেন যে, বাঁশিতেও রাগসঙ্গীত বাজানো যায়। যার ফলে পরে আমরা দেখলাম ওঁর ছাত্র বা ছাত্র নন এমন অনেকেই বাঁশিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। শোনা যায়, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া ওঁর কাছে শিখতে চেয়েছিলেন—পারেননি, উনি যে-কোনো কারণেই হোক শেখাননি।
পান্নালাল ঘোষ হয়তো থিতু হতে পারেননি কোথাও। সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এটা বিরল নয়। প্রবল খ্যাতি অথচ আর্থিক দুর্দশায় গেলেন বোম্বে, সিনেমায় কাজও করলেন কিছু, কিন্তু মনে হল যেন সুরে বাজছে না। চলে এলেন। ১৯৫৬ সাল নাগাদ আকাশবাণীতে বেশ কিছু অর্কেস্ট্রা উপহার দিলেন - কলিঙ্গবিজয়, ঋতুরাজ। ভারতবর্ষের আর্কাইভের চেষ্টা নির্লিপ্তিতে মেডেল পেতে পারে। লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে রেকর্ডিং-এ পান্নাবাবুকে এও শুনতে হয়েছে ওঁর থেকে, এত সুরে উনি বাজান কেন! লতা মঙ্গেশকর কবি সাহির লুধিয়ানভির কবিতায় গাইতে গিয়ে কেঁদে ফেলেছিলেন। রাধাকান্ত নন্দী মান্না দে’র একটা বিশেষ গানে বাজাতে গিয়ে মাঝপথে থামিয়ে বলেন, ‘আর গায়েন না,মান্নাদা।’ লতা মঙ্গেশকর, রাধাকান্ত নন্দীরা ওরকম বলেই থাকেন। আমাদের অত মাথা না ঘামালেও চলে।
২০১১ সালে ঘটা করে বাংলাদেশে পান্নালালের শতবর্ষ পালিত হয়। এখানে কী হয়েছে জানা নেই। পান্নালাল ঘোষ বেঁচেছিলেন মাত্র ৪৮ বছর। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার একটা অনন্য মত আছে। উনি বলছেন, পান্নালালবাবুই দেখালেন, প্রচণ্ড পরিশ্রম করলে সরোদ–সেতারের মতো জনপ্রিয় হতে পারে বাঁশিও। তাঁর এও মত যে, লোকে নতুন কিছু দেখলে নিন্দে করে। পান্নালালের রাগসঙ্গীত বাঁশিতে বাজানো নিয়েও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
তবু পান্নালাল হাল ছাড়েননি। প্রথাগত রাগ চর্চার বাইরেও নিজে রাগ সৃষ্টি করলেন - নূপুরধ্বনি, দীপাবলি। এমনও দিন গেছে, পান্নালালের দারিদ্র্যের খবর পেয়ে ভারতের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী বালাসাহেব বিশ্বনাথ কেসকার নিজে কলকাতায় এসে তাঁকে চাকরি দিয়ে দিল্লি নিয়ে যান। পান্নালাল ঘোষের ছাত্র ছিলেন দেবেন্দ্র মুরুদেশ্বর(যিনি ওঁর জামাইও বটে), গৌর গোস্বামী, ভি জি কার্নাড, মুকুল রায়, ফকিরচন্দ্র সামন্ত সহ বহু মানুষ। শুধু গায়কী অঙ্গই নয়, তন্ত্রকারী অঙ্গেও সমান দক্ষতা ছিল ওঁর।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে সময় উনি প্রয়াত হচ্ছেন, সে সময় বাংলা-হিন্দি গানের সত্যিকারের স্বর্ণযুগ। বাংলায় সিনেমা ও বেসিক গানের পাশে তৈরি হচ্ছে রম্যগীতি। যেখানে সুর দিচ্ছেন-বাজাচ্ছেন ভি বালসারা, অলোকনাথ দে, জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, নিখিল ঘোষ। এই নিখিলবাবু পান্নালালেরই ভাই। সে সময়ে চলে ওঁর চলে যাওয়া ‘দেশের ক্ষতি, জাতির ক্ষতি’ গোছের বিরাট শব্দবন্ধ প্রয়োগ করা সমীচীন নয়। তবে বহু মানুষের ব্যক্তিগত ক্ষতি। সুরের ক্ষতি। বাঁশির শরীরে যে গভীরতা আনা যায়, পান্নালাল ঘোষ দেখিয়ে গেলেন।
ঋণ- সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
তাঁতঘর পত্রিকা