১৯৯৪ সালে গুজরাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে খরার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বৃষ্টির কোনো সম্ভবনাই তখনও দেখা যায়নি। কিন্তু এর মধ্যে একটি জলসায় উপস্থিত হলেন পণ্ডিত যশরাজ। নানা সঙ্গীত পরিবেশনার পর ধরলেন রাগ মেঘমল্লার। চোখ বুজে নিমগ্ন হলেন সঙ্গীতের সাধনায়। আর চোখ খুলতেই দেখলেন আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। শোনা যায় প্রাচীনকালের ভারতীয় শিল্পীরা নাকি বৃষ্টি নামাতেই মেঘমল্লারের সুর ধরতেন। এই সুরে প্রকৃতি সাড়া দেয়। সেযুগের কাহিনি কতটা সত্যি জানা নেই। তবে পণ্ডিত যশরাজের ঘটনা সত্যিই অবাক করে। তবে তিনি নিজে কিন্তু অবাক হন না। বরং হাসতে হাসতে বলতেন, এর পিছনে তাঁর ভূমিকা কিছুই নেই। সবটাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জাদু। সত্যিই তিনি বিশ্বাস করতেন, সমস্ত মন-প্রাণ এক করে সঙ্গীতের চর্চা করতে পারলে প্রকৃতি সাড়া দেয়।
৯০ বছরের এই কিংবদন্তির সাম্প্রতিক মৃত্যু সেইসব দিনের কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে। সেইসঙ্গে অবাক হতে হয় সঙ্গীতের সঙ্গে তাঁর আজীবনের যোগাযোগের কথা ভেবেও। শেষ জীবনে আর দীর্ঘ খেয়াল ভাঁজতে পারতেন না। কিন্তু অসংখ্য অনুষ্ঠানে ঘুরে বেরিয়েছেন ঠুংরি, কীর্তনের সম্বল নিয়ে। সেই ছেলেবেলায় বেগম আখতারের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি। তারপর কতবার স্কুল পালিয়ে পৌঁছে গিয়েছেন গানের আসরে। স্কুলের শিক্ষকরা তাঁর বাড়িতেও অভিযোগ জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোভাবেই দমানো যায়নি তাঁকে। তারপর একদিন এই সঙ্গীতের টানেই পৌঁছে গেলেন গুজরাট।
গুজরাটেই যশরাজের সঙ্গে পরিচয় হয় মেওয়াটি ঘরানার। পরবর্তীতে এই ঘরানার একজন শিল্পী হিসাবেই পরিচিত হয়েছেন তিনি। বা বলা ভালো, মেওয়াটি ঘরানাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছেন পণ্ডিত যশরাজ। তার স্বীকৃতিও এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। পেয়েছেন তিনটি পদ্ম-পুরস্কারই। পাশাপাশি সঙ্গীত-নাটক অ্যাকাডেমি পুরস্কার, সঙ্গীতরত্ন পুরস্কার; আরও কত সম্মান। কিন্তু তবু তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছে, সঙ্গীতের সাধনায় তিনি সম্পূর্ণ সফল হননি। গত জানুয়ারিতেই জন্মদিনের দিন তিনি জানিয়েছিলেন, আসলে নিজেকে সফল মনে করলে আর নতুন কিছু করার কথা ভাবা যায় না। তাই নিজেকে ব্যর্থ মনে করতেই ভালোবাসেন তিনি।
অথচ এর মধ্যেও একেকটি ঘটনা যেন রীতিমতো অলৌকিক বলে মনে হয়। ১৯৮৭ সালে বারাণসীর হনুমান মন্দিরে বসে তিনি গাইছেন রাগ টোড়ি। সামনে অসংখ্য শ্রোতা বসে আছেন। এরমধ্যেই সামনের ছোটো ঝোপের ধার দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল কয়েকটি হরিণ। তখনও বারাণসীতে হরিণের এমন অবাধ বিচরণের স্থান ছিল। যেতে যেতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সেই হরিণের দল। শিল্পীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল ঠায় দৃষ্টিতে। আর রাগ শেষ করে যশরাজ যখন চোখ খুললেন, তখন তাঁর মধ্যে অবাক হওয়ার কোনো অনুভূতিই ফুটে উঠল না। তিনি তো জানেন, তানসেন যখন রাগ ভাঁজতেন তখনও এভাবেই দাঁড়িয়ে পড়ত হরিণের দল। কিন্তু সেসব তো ১৬ শতকের রূপকথা। বিশ শতকেও এমন অলৌকিক ঘটনা ঘটতে পারে?
১৯৪৫ সালে পণ্ডিত অমরনাথ চাওলার সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছিল মাত্র বছর ১৫-র একটি কিশোর। সঙ্গীতের ব্যাকরণ তখনও তার পুরোপুরি রপ্ত হয়নি। কিন্তু ব্যাকরণের দোহাই দিয়ে সঙ্গীতের মাধুর্যকে কি নষ্ট করা যায়? প্রশ্ন তুলেছিল সেই ১৫ বছরের ছেলেটি। সেই ছেলেটি আর কেউ নয়, স্বয়ং পণ্ডিত যশরাজ। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছিলেন, সেদিন পণ্ডিত অমরনাথ অনেক কথাই ঠিক বলেছিলেন। অন্তত শাস্ত্রের নিয়ম মেনে তো পুরোটাই ঠিক। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেননি, সঙ্গীতের আসল উদ্দেশ্য মনকে আকর্ষণ করা। আর সেই আকর্ষণের এক অদ্ভুত ক্ষমতা রপ্ত করেছিলেন যশরাজ। আজকের অনেক গানের শ্রোতাই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত যেন ঠিক পছন্দ করেন না। অথচ যশরাজের দরাজ গলার সামনে তাঁদেরও চুপ করে বসে থাকতে দেখা যায়। আজ আর সশরীরে উপস্থিত নেই তিনি। কিন্তু তাঁর সেই গানের কিছু রেকর্ড থেকে গিয়েছে। সেইসব রেকর্ড কি আগামী দিনেও বৃষ্টি নামাবে? হরিণের দল সেই রেকর্ড শুনে ইতিউতি খুঁজবে শিল্পীকে? তবে মানুষ যে সেই রেকর্ডের সামনে চুপ করে বসে থাকবেন, সেকথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
সুপ্রিয়ার সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগ দিতে হবে; ঋত্বিক ঘটককে শর্ত দিলেন দেবব্রত বিশ্বাস