স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরে লোকেরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছে ধৈর্য ধরে। কখন ডাক আসবে টিকা নেওয়ার? স্পেশাল ক্লিনিকগুলোতে প্রতি ঘন্টায় ইনজেকশন নিচ্ছে প্রায় ছশো জন. তবু মানুষের সারি ছোটো হওয়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মাথায় হাত দেওয়ার মতো অবস্থা। আচমকা ছড়িয়ে পড়া মারাত্মক ভাইরাস আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসা যে কোনও ব্যক্তির সন্ধানের জন্য মরিয়া চেষ্টা করছেন তাঁরা।
করোনা ভাইরাসের কবল থেকে রেহাই পেতে যখন সারা দুনিয়া চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে ভ্যাকসিনের দিকে, তখন খুব পরিচিত লাগছে কি ছবিগুলোকে? ঘটনাক্রম কিন্তু প্রায় ৭০ বছর আগেকার. ভয়ঙ্কর মারণ ভাইরাসের কবলে পড়া গ্লাসগো শহরের।
১৯৫০ সাল। ভয়াবহ স্মল-পক্সের কবলে পড়েছিল স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহর। এর জন্য দায়ী করা যেতেই পারে একজন ভারতীয় নাবিককে, যার মাধ্যমেই এই রোগ গ্লাসগোতে ছড়িয়ে পড়েছিল বলে মনে করা হয়। তারপর থেকে বহু জল গড়িয়েছে গঙ্গা দিয়ে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নির্মূল করাও সম্ভব হয়েছে স্মল-পক্স। তবে একটা সময় সারা বিশ্বে ত্রাস ফেলে দিয়েছিল এই মারণ ভাইরাস। কারণ, অনুমান করা হয় যে, কেবলমাত্র বিশ শতকেই এই রোগে মারা গিয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি লোক!
যুদ্ধোত্তর যুগে মহামারীর প্রভাব থেকে মোটামুটি মুক্তই ছিল ইউরোপ। তবে ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় নাবিক মুসা আলি গ্লাসগোতে পৌঁছানোর পরই বদল হয় পরিস্থিতির।
গ্লাসগোতে পৌঁছনোর পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মুসা আলি। নিউমোনিয়া বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হলেও চিকেনপক্সের লক্ষণও দেখা দেয় অচিরেই। গ্লাসগোর নাইটসউড এলাকার একটি সংক্রামক রোগের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে দেখা যায় যে আলির একাধিক রোগ ছিল এবং সেটিই ছিল অশনি সংকেত। আলির মাধ্যমেই এই মারণ ভাইরাস ১৯ জনকে সংক্রামিত করবে এবং ছয়জনের মৃত্যুর কারণ হবে। নিহতদের মধ্যে ছিলেন একজন চিকিৎসক, চারজন নার্স এবং একজন লন্ড্রির কাজ করা গৃহপরিচারিকা, যাঁদের সকলই হাসপাতালে মিঃ আলির সাথে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসেছিলেন।
তারপরেই গুরুতরভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস। মৃত্যুর হারও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। দেখা গিয়েছিল যে, যারা মারা গিয়েছিলেন, তাদের কেউই স্মল-পক্সের বিরুদ্ধে টিকা পাননি। ভাইরাসের প্রকোপ জনস্বাস্থ্য আধিকারিকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। ভ্যাকসিনের আশু প্রয়োজনীয়তা বোধ করেছিলেন তাঁরা তখনই। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে শুরু হয়ে টিকাকরণ।
আরও পড়ুন
ছড়াতে পারে নিপা-সহ একাধিক নোভেল ভাইরাস! আশঙ্কা নতুন মহামারীর
সরকারি হিসাবমতে, প্রথম ১২ দিনের মধ্যেই আনুমানিক ২,৫০,০০০ লোককে টিকা দেওয়া হয়েছিল গ্লাসগোতে। মহামারীর প্রাদুর্ভাব শেষ না হওয়া পর্যন্ত মোট ৩,০০,০০০ মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছিল।
এই প্রাদুর্ভাবের ফলে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তি ছিলেন হ্যামিল্টনের ২৯ বছর বয়সী ডাক্তার জ্যানেট ফ্লেমিং, যিনি আলিকে হাসপাতালে নিয়ে আসার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
ফ্লেমিংয়ের মৃত্যুর পরেই নড়েচড়ে বসেন দেশের স্বাস্থ্যকর্তারা। ফলস্বরূপ, দক্ষিণ লানার্কশায়ার শহরে একটি টিকাদান কর্মসূচি শুরু করা হয়। এই শহরের ৪০,০০০ বাসিন্দার তিন ভাগেরও বেশি বাসিন্দাকে এই ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছিল সফল ভাবে। সুস্থ হয়ে ওঠেন মুসা আলিও। সেই সময়ের সংবাদপত্রে ফলাও করে লেখা হয়েছিল, আলি সুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতালেই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানো হয় তাঁকে। বর্তমানেও কোভিড পরিস্থিতিতে রোগী বা স্বাস্থ্যকর্মীদেরকে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানানোর ছবি অবশ্যই স্মৃতি থেকে আলগা হয়ে যায়নি আমাদের এখনও।
আরও পড়ুন
উপসর্গ হাঁচি-কাশি, মারণ ভাইরাস হানা দিয়েছিল ব্যাটম্যানের শহরেও
গ্লাসগো যেভাবে সফল হয়েছিল, বর্তমান পৃথিবীও সেভাবেই কাটিয়ে উঠবে করোনা মহামারীর শঙ্কা, সেটাই আশার। সমস্ত বিশ্ববাসীই এখন তাকিয়ে আছে সেই দিকেই।
ছবি- প্রতীকী
Powered by Froala Editor