১৯১১ সাল। বেজে গেছে বঙ্গভঙ্গের ঘণ্টা। বাংলায় তখন নিজেদের একত্রিত করে নিচ্ছেন একদল তরুণ ফুটবলার। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবুজ ঘাসের মাঠে রক্ত ঝরাতে তৈরি করে নিচ্ছে নিজেদের। ঠিক সেই সময়েই ভারতীয় ভূখণ্ডের পশ্চিম প্রান্তে চলছে আরেক প্রস্তুতি। তবে সেখানে হাতিয়ার ক্রিকেট। খেলাকে সামনে রেখেই ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সারা ভারত থেকে সেরা ক্রিকেটারদের বাছাই করে তৈরি হল প্রথম ‘অল-ইন্ডিয়া’ দল। অধিনায়ক পাটিয়ালার রাজা ভুপিন্দর সিং। যদিও এই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রথম আবেদন গিয়েছিল প্রিন্স রণজিৎ সিংয়ের কাছে। তবে তিনি ফিরিয়ে দেন সেই আবেদন। কারণ ভারতের হয়ে খেলে ব্রিটিশ-সখ্যে আঁচড় আনার পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি।
আর্থিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম স্বদেশি ব্যবসাপতি জামশেদজী টাটার দুই পত্র রতনজি টাটা এবং দোরাবজি টাটা। তবে দল তৈরির পরে দেখা দিল অন্য একটি সমস্যা। ক্রিকেট যে সভ্য সমাজের খেলা। কিন্তু দলের মধ্যে জায়গা পেয়েছেন দুই দলিত ক্রিকেটার। যার মধ্যে একজন আবার রয়েছেন প্রথম একাদশে। কাজেই বেশিরভাগ উচ্চবর্গের ক্রিকেটাররাই বেঁকে বসলেন তাঁর সঙ্গে খেলতে। দলগঠনের পিছনে থাকা অন্যতম ব্যক্তি, ইউরোপিয়ান ক্রিকেটার জন গ্লেনি গ্রেগ সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। কাজেই অপরিবর্তিত দলই শেষ অবধি পাড়ি দিল ব্রিটেনে।
যে দুই ক্রিকেটারের কথা বলা হচ্ছে তাঁর মধ্যে একজন হলেন পালওয়ঙ্কর বালু। আর অন্যজন তাঁরই ভাই পালওয়ঙ্কর শিবরাম। ব্রিটেনের সেই তিন মাসের ট্যুরে তেমন সাফল্য পায়নি ভারত। ব্রিটেনে গিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং অধিনায়ক ভুপিন্দর সিং এবং অন্যতম ব্যাটসম্যান কেকি মিস্ত্রি। সেই সঙ্গে প্রথম থেকেই প্রিঞ্জ রঞ্জির অনুপস্থিতি তো ছিলই। ফলে ব্রিটিশ বোলিংয়ের সামনে সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তবে তারপরেও ম্যাচ জেতা খুব একটা সহজ হয়নি ব্রিটেনের ক্রিকেটারদের। তার একমাত্র কারণ হল পালওয়ঙ্কর বালুর উপস্থিতি। সেই ট্যুরে ১১৮টি উইকেট নিয়ে পুরো টুর্নামেন্টের সেরা উইকেট শিকারির স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনলেন একজন ভারতীয়। শুধুমাত্র ‘জাতি’-র দোহাই দিয়েই যাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছিল একটা সময়। সেই বালু’র জন্যই শেষ অবধি মুখরক্ষা হল ভারতীয় দলের।
তবে এই বৈষম্যের এই আঁচ তাঁর গায়ে লেগেছিল একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকেই। ওই যে চর্মকার পরিবারে বেড়ে ওঠা। ফলে কাজ জুটলেও তা হল মজদুরি। পুনের ক্রিকেট ক্লাবে ঘাস ছাঁটাই, পিচ রোলিং, প্র্যাকটিসের নেট টাঙানো এসবই হল তাঁর কাজ। মাইনে মাস গেলে মাত্র ৪ টাকা। তবে অচ্ছুৎ হওয়ায় দুরত্ব বজায় রাখতে হবে ক্রিকেটারদের থেকে। শর্ত ছিল এই একটাই।
দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলতে যা বোঝায়। সেই সময়ে ভারতের ব্রিটিশ ক্রিকেটার জন গ্লেনি গ্রেগ এক কথায় তেমনই। যাঁর কথা উল্লেখ করেছি আগেই। প্র্যাকটিশ শেষ হয়ে গেছে ক্লাবের। কিন্তু অবসর সময়টুকুও ঝালিয়ে নিতে চাইতেন গ্রেগ। কিন্তু বোলার? ব্রিটিশ ব্যক্তির কাছে আর উঁচু-নিচু জাত-পাতের হিসেব কই? সকলেই তাঁদের কাছে বিবেচিত কালো নেটিভ হিসাবে। কাজেই মাঠ পরিচর্যার বছর পনেরোর দলিত ছেলেটিকেই ডেকে নিলেন তিনি। হাতে তুলে দিলেন ক্রিকেট বল।
কয়েকদিন এভাবেই চলল তাঁর বাড়তি প্র্যাকটিস। আর তারপরেই গ্রেগ টের পেলেন এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী এই কিশোর। তা হল লেগ স্পিন। বেশ কয়েকবার অপ্রত্যাশিত ভাবেই আউট হলেন গ্রেগ। নিজেকে তৈরি করার থেকেও সেই ছেলেটিকে খেলার উপযুক্ত করে তুলতে একটা আলাদা খিদে টের পেলেন গ্রেগ। প্রতিবার তাঁকে আউট করতে পারলেই ৫০ পয়সা করে বকশিশ পাবে কিশোর। এমনই শর্ত রাখলেন তিনি।
আরও পড়ুন
২৩০ বছর পেরিয়ে, কেমন আছে 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব'?
শুরু হল নিজেকে নিঙরে দেওয়া। শুরু হল একটা অসম লড়াই। তার বছর দুয়েকের মধ্যেই পুনের দলে বোলার হিসাবেই লিখিত হল পালওয়ঙ্কর বালুর নাম। হলেন ভারতের প্রথম দলিত ক্রিকেটার। আসলে ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে মাঠে নামতে গেলে দরকার শক্ত বোলার। শুধু সেই কারণেই দলে নেওয়া তাঁকে। কিন্তু ওই যে ‘দলিত’ জুড়ে আছে তাঁর নামের সঙ্গে। ফলে খেলার সুযোগ পেলেও অপরিবর্তিত থাকল দূরত্ব বজায় রাখার শর্ত। বিবেচনা করা হল শুধু বল ছোঁয়ার বিষয়টুকুকে। দলের বাকি ক্রিকেটারদের সঙ্গে রেস্টরুমে যাওয়ার অনুমতি তো দূরের কথা। ক্রিকেট ম্যাচ চলাকালীনও বালুকে খাবার খেতে হত মাটির থালায়। মাঠের ধারে চড়া রোদের মধ্যে বসেই। যেখানে বাকিদের খাবার আসত পোর্সেলিন কিংবা আভিজাত্যে মোড়া কাঁসার-পিতলের থালায়।
১৮৯৬ সালে বালুকে দলে টানল জিমখানা ক্রিকেট দল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু’দের নিয়ে গড়া দল মাঠে নামল। মাঠে নামলেন পালওয়ঙ্কর বালুও। সেই সময় ক্রিকেট বলতে টেস্ট ক্রিকেটই। প্রথম ইনিংসে হিন্দুদের রান ছিল ২৪২। ব্রিটিশরা করল ১৯১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্রিটিশ লক্ষ্য ছিল ২১২ রানের। তবে পালওয়ঙ্কর বালুর কাছেই থামলেন তাঁরা। মাত্র ১০২ রানে। একা ৫টি উইকেট নিলেন বালু। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস।
২০০১ সালে নির্মিত ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘লগান’-এ কাছরা’র চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল বালুর কথা মাথায় রেখেই। বেশ কিছু বিশেষজ্ঞের বিশ্লেষণেই উঠে আসে এমন অভিমত। তবে বাস্তবের মাটিতে ক্ষুরধার স্পিনের পরেও দলের বাকিদের থেকে সম্মান পাননি পালওয়ঙ্কর। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পাননি অধিনায়কত্বের টুপি। ব্যাটিংয়ের সুযোগও। পাবেনই বা কীভাবে? ব্যাটিং যে বেশি সম্মানজনক। বরং বোলিংয়েরই ‘মাহাত্ম্য’ নেই কোনো। এই ধারণা আজও গেঁথে রয়েছে আমাদের মনে। তবে খুব কিছু খারাপ ব্যাটসম্যান ছিলেন না বালু। ৩৩টি খেলা প্রথম সারির ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৭৫৩ রান। যার মধ্যে রয়েছে ৩টি অর্ধশতক।
আরও পড়ুন
একদিকে হাওয়াইয়ান গিটার, অন্যদিকে ক্রিকেট - কলকাতা মাতানো এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের কথা
ভারতের অন্যতম এই ক্রিকেটার আজ স্মৃতির অতলেই। শুধুই কি ক্রিকেট? ১৯৩০ সালে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গান্ধীজি যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তার বহু বহু বছর আগে থেকে সেই লড়াইটাই তো লড়ে এসেছিলেন পালওয়ঙ্কর বালু। শিখিয়েছিলেন, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজেকে ‘ভারতীয়’ হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা পাওয়া প্রিন্স রঞ্জির নামে প্রথম সারির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থাকলেও, ক্রিকেটের ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গেছে বালুর নাম। এসবের পরেও কি বলা যায় উনিশ শতকের থেকে এতটুকু এগিয়েছি আমরা? অন্তত বৈষম্যের দিক থেকে? আজকের সময়েও তাই বৈষম্য ও ক্রিকেটের কথা উঠলেই প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে তাঁর নাম...
তথ্যসূত্র –
১। Dalit Cricketer - Palwankar Baloo (Documentary Film, Nashiruddin Shah)
আরও পড়ুন
ধোনির ছোট্ট মেয়েকে ধর্ষণের হুমকি; ক্রিকেট কি এই শিক্ষাই দিচ্ছে আমাদের?
২। Why India has forgotten its first dalit cricketer – Dhrubo Jyoti - Print
৩। “Jungly Greig” : India’s first little master – Abhishek Mukherjee – Cricket Country
৪। From disdain to heroes: Journey of the two dalit brothers in India’s first cricket team – Prasant Kadambi – Print
Powered by Froala Editor