প্যাকিং হয় দুর্গারও, কুমোরটুলি থেকে বিমানে চেপে পাড়ি দেন বিদেশে

দুর্গার বিদেশভ্রমণ - ৩

প্রতিবছর সারা বিশ্বজুড়ে হয় অসংখ্য দুর্গাপুজো। কৌতূহল জাগে, এত পুজোর ঠাকুর কুমোরটুলি থেকেই যায়? কী করে প্রতিমা যায় এত দূরে? যোগাযোগই বা হয় কী করে? টাকা পান কীভাবে শিল্পীরা? কোন কোন শিল্পী প্রতিমা পাঠান?

উত্তরের খোঁজে কুমারটুলির গলিতে খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল সুনীল পালের গোলা। সুনীল বাবুর ছেলে মন্টু পাল জানান, তিরাশি সাল থেকে তাঁদের প্রতিমা যাচ্ছে বিদেশে। এবারেও গেছে। কুমারটুলির যে-সমস্ত শিল্পী বিদেশে ঠাকুর পাঠান তাঁদের ঠাকুরগুলি মোটামুটি প্রায় সবই আগস্টের প্রথম সপ্তাহে শেষ হয়ে, মাসের মাঝামাঝি সময়ে রওনা দিয়ে দেয়। নইলে পৌঁছনো যাবে না সঠিক সময়ে। কত দাম হয় প্রতিমার? মন্টুবাবু জানান, ‘প্রতিমার দাম ঠিক হয় কাজের কোয়ালিটি আর প্রতিমার সাইজের উপরে।’ তাঁর ফাইবার গ্লাসের বানানো প্রতিমা সাজ সহ এক একটির দাম পড়ে দেড় থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকার মতন।

আরও পড়ুন
কেন মুখ ফেরাচ্ছে নতুন প্রজন্ম? কুমোরটুলির ভবিষ্যৎ কি তবে রপ্তানিই?

শিল্পালয়ের মালিক বিশ্বজিৎ সরকার জানান, তাঁদের তৈরি শোলার ঠাকুর প্রতি বছরই বিদেশে যায়। তাঁরা ফাইবার গ্লাসের প্রতিমা বানান না। সাত থেকে সাড়ে সাত ফুট একটি প্রতিমার দাম পড়ে সত্তর আশি হাজার টাকা থেকে দেড় লাখের মতন। বিশ্বজিৎ বাবুর কথায়, ‘চুয়াত্তর সাল থেকে আমরা বিদেশে ঠাকুর পাঠাচ্ছি। আগে এমন চাহিদা ছিল না। তবে ইদানিং চাহিদা বেড়েছে।’ কীভাবে পাঠান তাঁরা প্রতিমা? ‘প্রতিমা সাধারণত জাহাজ বা কার্গো ফ্লাইটে যায়। এবছর আমাদের একটি প্রতিমা জাহাজে ও একটি কার্গোতে গেছে।’

বিদেশের বারোয়ারিগুলির মধ্যে সেরা নিউইয়র্ক। ওদের মোড অফ পেমেন্ট খুব ভালো।

কেমন খরচ? এভাবে পাঠাতে গেলে ভেঙেচুরে যায় না? বিখ্যাত প্রতিমা শিল্পী মন্টি পাল জানান, ‘প্যাকিং এমন ভাবে করা হয় যাতে ড্যামেজ হওয়ার চান্স খুব কম থাকে। শুধু প্যাকিং করতেই খরচ পড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। প্যাকিং-এরও রকমফের আছে। একচালার মূর্তি হলে খরচ কম। পার্ট পার্ট হলে খরচ বেড়ে যায়। নিয়ে যাওয়ার খরচ বারোয়ারির। কখনও আমরাও পাঠাই। আমি যেমন এভারেস্ট বিল্ডিং-এর ঈগল লজিস্টিক্সের মাধ্যমে পাঠাই। পার্টি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলে আমার কাজ শুধু প্যাকিং করে দেওয়া।’ মন্টি পাল সেই বিখ্যাত শিল্পী যিনি ২০১৫ সালে যোধপুর পার্ক বারোয়ারির বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা বানিয়েছিলেন। ২০১৬-তে  তিনি ওই মণ্ডপেইই হাজার হাত দুর্গা বানিয়েছেন। প্রতিবছর তার তৈরি ঠাকুর বিদেশে যায়। এখন অব্দি লস এঞ্জেলস, সিঙ্গাপুর, পার্থ, কার্ডিফ, সাউথ আফ্রিকাতে তাঁর ঠাকুর গেছে।

একই বক্তব্য কুমারটুলির সভাপতি নিমাইচন্দ্র পালের। বৃদ্ধ নিমাই বাবু এখনও ঠাকুর বানান। তাঁর কথায়, ‘১৯৯৬ সালে আমি প্রথম ঠাকুর পাঠাই লন্ডনে, তারপর এথেন্স, পার্থ, সিডনিতে ঠাকুর যায়। এবারেও আমার তৈরি ঠাকুর গেছে পার্থে। আমি সোজাসুজি ডাইরেক্ট এজেন্টের মাধ্যমে ঠাকুর বিদেশে পাঠাই ফ্লাইটে। আমি সাধারণত গতি ট্রান্সপোর্টে প্রতিমা পাঠাই। ট্রান্সপোর্ট খরচ পড়ে মোটামুটি দেড় লাখ টাকা, যদি একচালির ঠাকুর না হয়। আর এক চালির হলে ৮০ হাজারের মতন খরচ।’ প্রশ্ন করেছিলাম, কীভাবে আপনারা যোগাযোগ করেন বিদেশের বারোয়ারিগুলির সঙ্গে? তাঁর উত্তর, ‘সবসময় যে আমরা যোগাযোগ করি তা নয়, ওঁরাও যোগাযোগ করেন আমাদের সঙ্গে। হয়ত কলকাতায় এমন কোনো বারোয়ারির ঠাকুর বানিয়েছি যাদের কোনো সদস্যের আত্মীয় বিদেশে থাকে। আমার কাজ ভালো লাগলে তখন সেই সদস্যই হয়ত আমার নাম বলেন, যোগাযোগ করিয়ে দেন। এছাড়াও বিদেশের বারোয়ারিগুলির ওয়েবসাইটেও আমরা যোগাযোগ করি।’

আমরা এমন কিছু নতুন জিনিস করতে চাইছিলাম যাতে সাউথ এশিয়ান কমিউনিটির মানুষকে আকর্ষিত করতে পারি, এবং দুর্গা প্রতিমাই সেক্ষেত্রে ছিল আদর্শ।

টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা হয় না? এখনও অব্দি বিদেশের কোন বারোয়ারি তাঁর মতে সেরা? ‘টাকাপয়সার ক্ষেত্রে বিদেশের বারোয়ারিগুলি তেমন দর কষাকষি করে না। তারা চায় ভালো কাজ। কাজ ভালো হলে উপযুক্ত দাম দিয়ে তারা নিয়ে যায়। এমন অনেকবার হয়েছে আগ্রিম না নিয়েই প্রতিমা তৈরি করে বিদেশে পাঠিয়েছি। প্রতিমা পৌঁছানো মাত্র তারা টাকা দিয়ে দিয়েছে। একটা টাকাও মার যায়নি। বিদেশের বারোয়ারিগুলির মধ্যে সেরা নিউইয়র্ক। ওদের মোড অফ পেমেন্ট খুব ভালো।’

২০১৩ সালে ভয়েস অফ বেঙ্গল নামে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে একটি এগজিবিশন হয় পুজোর এক মাস আগে। নিমাইবাবু একমাস ধরে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে বসে দুর্গাপ্রতিমা বানান। তাঁর বানানো সেই প্রতিমাটি মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষ লন্ডনের সবথেকে পুরোনো বারোয়ারি লন্ডন দুর্গাপূজা দশেরা কমিটিকে(LDPDC) উপহার দেন। মিউজিয়ামের তরফে ব্রায়ান ড্যুরাল জানান, ‘এটি লন্ডন মিউজিয়ামে চলা ভয়েস অফ বেঙ্গলের একটি অংশ। আমরা এমন কিছু নতুন জিনিস করতে চাইছিলাম যাতে সাউথ এশিয়ান কমিউনিটির মানুষকে আকর্ষিত করতে পারি, এবং দুর্গা প্রতিমাই সেক্ষেত্রে ছিল আদর্শ।’

ছবি - সমীরণ

More From Author See More

Latest News See More