লোহার শিকের মাঝে আবদ্ধ ছোট্ট আলো-বাতাসহীন ঘর। সেখানেই খাওয়া-দাওয়া, শোয়ার বন্দোবস্ত, সেখানেই শৌচকর্মের ব্যবস্থা। জেলখানা বললে সাধারণত এমন ছবিই ভেসে ওঠে সকলের চোখে। কিন্তু নিজের জেলখানা যদি নিজের মনের মতো করে তৈরি করার অধিকার পান কেউ? কয়েদি যদি বিলিয়নেয়ার হন, গোটা দেশজুড়ে তার অবিসংবাদিত প্রতাপ থাকে, তবে এর মধ্যে আশ্চর্যের নেই কিছুই।
পাবলো এস্কোবার (Pablo Escobar)। আলাদা করে এই ব্যক্তির পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আশি, নব্বই-এর দশকে বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি এবং ক্রাইম লর্ড হয়ে উঠেছিল কলম্বিয়ার এই ড্রাগ মাফিয়া। হিসেব অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে উৎপাদিত কোকেনের প্রায় ৮০ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করত এস্কোবার। কলম্বিয়া তো বটেই, এস্কোবার নিজস্ব বিমানে করে সেই কোকেন সরবরাহ করত আমেরিকা, ইউরোপ, আফ্রিকায়। তারপর তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ত অন্যান্য দেশেও। তাছাড়া প্রায় ৪০০০ মানুষকে হত্যা করেছিল এস্কোবারের দল। পাবলো এস্কোবারের এই কর্মকাণ্ড নিয়ে নতুন করে বলার নেই কিছুই। তবে এস্কোবার নিজের জন্য বিলাসবহুল ব্যতিক্রমী এক কারাগার গড়ে তুলেছিল, তা অজানা অনেকেরই। কিন্তু এমন আশ্চর্য ঘটনার কারণ কী? কেনই-বা তাকে নিজের তৈরি কারাগারে দিন-কাটানোর সুযোগ দিয়েছিল কলম্বিয়ান সরকার?
অপরাধের দুনিয়ায় এস্কোবার পা রেখেছিল সামান্য গাড়ি চোর হিসাবে। পরবর্তীতে নিজে কাজ করত পাচারকারী হিসাবে। কখনও কখনও অপহরণ করতেও তাকে বিভিন্ন জায়গায় পাঠাত সে-যুগের কলম্বিয়ান ড্রাগ মাফিয়ারা। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে নিজের চক্র শুরু করে এস্কোবার। ক্ষুরধার বুদ্ধি এবং পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে একাধিপত্য স্থাপন করে কলম্বিয়ার মাদকজগতে। হয়ে ওঠে ‘কিং অফ কোকেন’। শুধুমাত্র কোকেন বিক্রি করেই বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় ৭ নম্বরে উঠে এসেছিল এস্কোবার। থানা-পুলিশ থেকে শুরু করে সরকারি কর্মী, ম্যাজিস্ট্রেট, এমনকি বিচারকদেরও পুরে ফেলেছিল নিজের পকেটে। আর বিরুদ্ধাচরণ করলে পরিণাম ছিল মৃত্যু। এস্কোবারের কাছে খুব সহজ ছিল হিসেবটা, ‘হয় ঘুষ, নয় বুলেট’। এই দুই বিকল্পের মধ্যে বেছে নিতে হত যে-কোনো একটিকে। কিন্তু প্রশাসনের হাতে কি কোনো ক্ষমতাই ছিল না এই দুঁদে অপরাধীকে রোখার জন্য?
হ্যাঁ, ছিল। তবে দেশের লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ এস্কোবারের ভক্ত হওয়ায়, কোনোদিনই সেভাবে জুত করে উঠতে পারেনি প্রশাসন। তাদের কাছে এস্কোবার ছিল ভগবান। কলম্বিয়ার অ্যান্টিওক্যুইয়া প্রদেশের মেডেলিন শহর ঘিরেই গড়ে উঠেছিল এস্কোবারের এই চক্র। আর এই শহরের দরিদ্রদের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করত সে। গড়ে তুলেছিল বিশেষ হাসপাতাল, স্কুল, কলেজ। গৃহহীনদের তৈরি করেছিল মাথা গোঁজার আশ্রয়। ফলে, এই শহরে পুলিশ ঢুকলেই এস্কোবারের বাহিনীর কাছে পৌঁছে যেত খবর। কখনও আবার সাধারণ মানুষই পুলিশের পথ রুখে দাঁড়াত তাদের ‘রবিন হুড’-এর জন্য। ১৯৮২ সালে কলম্বিয়ার সাংসদ হিসাবেও নির্বাচিত হয়েছিল এস্কোবার। যদিও ২ বছরের মধ্যে পদত্যাগ করতে হয় তাকে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সুযোগও এসেছিল তার কাছে।
এস্কোবারের সঙ্গে কলম্বিয়ান প্রশাসনের সংঘাত চরম পর্যায়ে পৌঁছায় আশির দশকের শেষলগ্নে। একদিকে যেমন নির্বিচারে এস্কোবারের শিকার হতে থাকে দেশের সরকার কর্মচারী, পুলিশ, স্পেশাল ফোর্স, বিচারক, আইনজীবী এবং মন্ত্রীরা, তেমনই আন্তর্জাতিক স্তরেও কলম্বিয়ার ওপর চাপ তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্র। কেন-না, এস্কোবারের পাচারচক্র ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল মার্কিন প্রশাসনের।
এই টালমাটাল সমীকরণের মাঝেই ছোট্ট একটি ভুল করে ফেলে এস্কোবার। ১৯৮৯ সাল। খবর এসেছিল, কলম্বিয়ার রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বিমানে চেপে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়ে আসছেন কলম্বিয়ায়। খবর পেয়েই বিমানে বিস্ফোরণ ঘটায় এস্কোবার। না, রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী সেই বিমানে ছিলেন না ঠিকই, তবে এস্কোবারের এই কর্মকাণ্ডে প্রাণ হারান প্রায় ১০০ জন মানুষ। সেই তালিকায় ছিলেন দুই মার্কিন গোয়েন্দাও। এই ঘটনার পর রীতিমতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কোমর বেঁধে নামে এস্কোবার-শিকারে। তাকে প্রত্যার্পণের চুক্তি হয় কলম্বিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে কলম্বিয়ান সরকারের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব রাখে এস্কোবার। জানায়, ১০০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ কিছুদিনের মধ্যেই শোধ করে দিতে প্রস্তুত। তবে শর্ত ছিল, কোনো সরকারি কারাগারে রাখা যাবে না তাকে। কারাগার বানাবে সে নিজেই। সেখানে তারই দেহরক্ষীরা থাকবে, সরকারের বাহিনী থাকবে কারাগার থেকে কমপক্ষে ১২ মাইল দূরে। সঙ্গে কোনোভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না তাকে।
দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে শেষ পর্যন্ত এস্কোবারের এই প্রস্তাবকেই মেনে নেয় কলম্বিয়ান সরকার। রায় দেয় ৫ বছরের কারাবাসের। এর কয়েক মাসের মধ্যেই গড়ে ওঠে এস্কোবারের বিলাসবহুল কারাগার। ‘লা ক্যাথিড্রাল’। জিম থেকে শুরু করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর, সুইমিং পুল, বার, স্পা, হেলিপ্যাড, টেনিস কোর্ট, বুল ফাইটিং-এর রিং— সবকিছুই মজুত ছিল সেখানে। ছিল বিশ্বমানের আস্ত ফুটবল স্টেডিয়ামও। কারাগারে থাকাকালীন কলম্বিয়ার জাতীয় ফুটবল দলকে এই স্টেডিয়ামে নিয়ে এসে খেলিয়েও ছিল এস্কোবার। এসবের বাইরে দৈনন্দিন এই কারাগারে আনাগোনা লেগে থাকত যৌনকর্মীদের। বাইরে থেকে আসত দামি দামি রেস্তোরাঁর খাবার। তবে কারাগার থেকে বাইরে না-বেরোলেও, বন্ধ হয়নি এস্কোবারের পাচারচক্র। সেখান থেকেই বিভিন্ন লোক-মারফত কোকেন পাচারের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেত এস্কোবার। যদিও নিজের তৈরি এই কারাগার, থুড়ি স্বপ্নপুরীতে মাত্র ১৩ মাস সময় কাটানোর সুযোগ পায় কুখ্যাত ড্রাগ-মাফিয়া।
১৯৯২ সালে কলম্বিয়ান প্রশাসনের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে, এস্কোবার কারাগারের মধ্যে চার সহকর্মীকে হত্যা করার পর। ঠিক হয় তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে সরকারি জেলখানায়। গোটা জেলখানা ঘিরে ফেলে কলম্বিয়ার স্পেশাল ফোর্স। তবে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে গোপন সুড়ঙ্গ দিয়েই পালিয়ে যায় এস্কোবার। এরপর প্রায় দেড় বছর ধরে চলেছিল চোর-পুলিশের পালিয়ে বেড়ানোর খেলা। ১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর, জন্মদিনের ঠিক পরের দিন তার ফোনকল ট্রেস করেই জানা যায় অ্যান্টিওক্যুইয়ার একটি বাড়িতে লুকিয়ে রয়েছে সে। সঙ্গে সঙ্গেই পরিকল্পনা হয় এনকাউন্টারের। এনকাউন্টারের পর তার মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছিল সেই বাড়ির ছাদ থেকে। অবশ্য এস্কোবার পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিল, নাকি পথ না-পেয়ে নিজেই আত্মহত্যা করেছিল— তা আজও স্পষ্টভাবে জানা নেই কারোর। তারপর পেরিয়ে গেছে প্রায় তিন দশক। তবে নিজের তৈরি জেলখানায় কারাবাস করার সৌভাগ্য আর দ্বিতীয় কারোর হয়নি বললেই চলে।
Powered by Froala Editor