যিশুর প্রতীক হিসেবেই আবির্ভাব ক্রিসমাস ট্রি-র, তারায় মিশে বেথলেহেমের স্মৃতিও

দেখতে দেখতে ২০২০-র শেষ মাসটি চলে এল। শীতের ভারে জবুথুবু আমরা। এসবের সঙ্গেই রয়েছে বছর শেষের সবচেয়ে বড়ো উৎসব— বড়োদিন। যিশুখ্রিস্টের জন্মমুহূর্তটিকে স্মরণে রাখতে গোটা বিশ্বের মানুষ মেনে ওঠেন আনন্দে। শুরু হয় ‘ক্রিসমাস ইভ’। আর এই ইভের কথা এলেই এসে পড়ে ক্রিসমাস ট্রি-এর কথা। বড়োদিনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যে গাছটি জড়িয়ে গেছে। ধীরে ধীরে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে এই ক্রিসমাস ট্রি। ইউরোপ-আমেরিকার মতো পাশ্চাত্যে তো বটেই; ভারতের মতো দেশেও রীতিমতো জনপ্রিয় এই গাছ।

ইতিহাসেরও ইতিহাস থাকে। আজ ক্রিসমাস বললে অবধারিতভাবে যে গাছটির কথা মাথায় আসে, সেটির আগমন কবে থেকে? আর কেনই বা আগমন ঘটল? এসব নানা প্রশ্ন আমাদের মধ্যে ঘুরতে থাকে। একটু পেছনে ফিরে দেখা যাক তাহলে!

মূলত চিরহরিৎ ফার গাছকেই ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেবদারু গাছের মতো দেখতে, লম্বা, পিরামিডের মতো আকৃতির এই গাছটি আজ প্রায় সব জায়গায় দেখা যায়। কিন্তু ঠিক কবে ক্রিসমাস ট্রি-এর আগমন ঘটেছে, তা নিয়ে নানা মহলে নানা বিতর্ক। মনে করা হয়, আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে, উত্তর ইউরোপে এটি ক্রিসমাস উৎসবের অঙ্গ হয়ে ওঠে। আজকের মতো এত জমকালোভাবে সাজানো হত না। যদি গোটা গাছটি না পাওয়া যেত, তাহলে ফার গাছের কোনো প্রতিকৃতি তৈরি করা হত ঘরে। সেটাও না হলে, কাঠ কেটে স্তরে স্তরে সাজিয়ে পিরামিডের আকৃতি দেওয়া হত। তারপর ক্রিসমাস ট্রি-এর মতোই সাজানো হত…

ইতিহাসের পাতা ওলটালে দেখা যাবে, পনেরো শতকের শেষের দিকে প্রথমবার ক্রিসমাস ট্রি-এর ব্যবহার হয়েছিল। অবশ্য এটি আধুনিক কালের হিসেব, তাও ডকুমেন্টেড। এর আগে কেমনভাবে ব্যবহৃত হত এই গাছ, তার কোনো প্রমাণ নেই। তবে হত, সে ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিত বিশেষজ্ঞরা। প্রথম প্রামাণ্য নথি নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। মনে করা হয়, ১৪৪১ সালে এস্টোনিয়ার তাল্লিনে প্রথমবার জনসমক্ষে ক্রিসমাস ট্রি সাজিয়ে রাখা হয়। আবার অন্য অংশ মনে করে, লাটভিয়ার রিগায় ১৫১০ সালে প্রথমবার এই গাছ ব্যাপকভাবে সামনে আসে। কোনটি সত্যি, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকলেও, এখান থেকেই যে প্রথম ক্রিসমাস ট্রি-এর জনপ্রিয়তার সূত্রপাত সেটা অস্বীকার করা যায় না।

তবে কেবল বাইরেই তো নয়, ঘরের ভেতরেও তো সাজিয়ে রাখা হয় ক্রিসমাস ট্রি। প্রথমে এই জিনিসটি করা হত না। যা হত, সব খোলা আকাশের নিচে। ১৬-র শতকেই জার্মানিতে প্রথমবার ঘরের ভেতর ক্রিসমাস ট্রি অর্থাৎ ফার গাছ এনে বড়োদিন পালন করা হয়। ধীরে ধীরে সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এই গাছ। আঠেরোশো শতকে আমেরিকায় জার্মানদের কল্যাণে প্রবেশ করে এটি। তৈরি হয় ক্রিসমাস ইভের একটি প্রথা। তবে ইংল্যান্ডে ক্রিসমাস ট্রি-এর আগমন ঘটেছে অনেক পরে, বলা ভালো ঊনবিংশ শতকের শুরুতে। এই তথ্যটি খানিক আশ্চর্যই করে আমাদের। জার্মানি, লাটভিয়া-সহ অন্যান্য জায়গায় এত ব্যাপকভাবে প্রচলন হওয়ার পরও ইংল্যান্ডে কেন দেরিতে পৌঁছল, জানা যায় না। কিন্তু একবার পৌঁছনোর পর জনপ্রিয়তা পেতে সময় লাগেনি। বাকিটা তো ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে গেছে আজ। ইউরোপের গণ্ডি ছাড়িয়ে ক্রিসমাস ট্রি আজ সর্বজনীন…

কিন্তু ক্রিসমাস ট্রি-এর এত মাহাত্ম্য কেন? এর পেছনেও রয়েছে প্রথার হাত। ক্রিসমাস ট্রি যেন স্বয়ং যিশুরই প্রতিকৃতি। সমস্ত জায়গায় গির্জার মতো ক্রুশবিদ্ধ যিশুর মূর্তি তো থাকে না; বিশেষ করে খোলা রাস্তায়। সেখানেও যাতে যিশুর উপস্থিতি থাকে, সেজন্যই আগমন এই ক্রিসমাস ট্রি-এর। চিরহরিৎ সবুজ লম্বা ফার গাছটি যেন জীবনের প্রতীক, স্বয়ং যিশুর মতোই। এই গাছও ভগবানের সন্তান। আর পাতার আড়ালের গুঁড়িটিকে কাঠের ক্রুশের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। এরপরই আসবে সাজসজ্জার কথা। আলো দিয়ে, তারা, বেল, লাল-সবুজ কাপড়ে সাজানো হয় গাছটিকে। প্রতিটা জিনিসই একেকটা অর্থ নিয়ে হাজির হয়। ক্রিসমাস ট্রি-এর ওপরে বা পাশে যে মস্ত তারাটি থাকে, সেটির সঙ্গে মিল আছে বেথলেহেমে যিশুর জন্মের কাহিনির। মনে আছে, প্রাচ্য থেকে তিন বিদ্বান আকাশে নতুন একটি তারা দেখতে পান! সেই তারা দেখেই উপহার নিয়ে জেরুজালেমে উপস্থিত হন ওই বিদ্বানরা। ক্রিসমাস ট্রি-র তারাও সেই প্রতীক।

আরও পড়ুন
যিশুর পদধূলি পড়েছিল এই মেঝেতেই! ২০০০ বছর পর পুনর্নিমাণ প্রত্নতাত্ত্বিকদের

গাছের গায়ে আর কোনো রং থাকুক বা না থাকুক, লাল-সবুজ-সোনালি-রুপোলি রং থাকবেই। রং না থাকলেও, সেই রংয়ের আলো থাকে। যিশু তো নিজেই ভগবানের দূত; আলো সেই অসীম জ্ঞানরশ্মির প্রতীক। লাল রং মনে করায় যিশুর রক্তাক্ত দেহকে, সবুজ রং জীবনকে, আর সোনালি-রুপোলি রং মনে করায় রাজা যিশুকে। যার শরীরের ভেতর ভগবানের রক্ত বইছে। এই সমস্ত অবয়ব নিয়ে যিশু হাজির হন ক্রিসমাস ট্রি রূপে। আমরাও তাঁকে গ্রহণ করে নিই। অচিরেই মেতে ওঠে পৃথিবী।

Powered by Froala Editor