গম্ভীর মুখ থেকে সবাইকে হাসিয়েছিল ক্যামেরা, সেখান থেকেই শুরু ‘সে চিজ’-এর যাত্রা

বিশ্বায়নের যুগে আজ সমস্ত গণ্ডি পেরিয়ে এক হয়ে গেছি আমরা। ছবির জগত আরও কাছে টেনেছে। এদেশ হোক বা বিদেশ— অনুষ্ঠানে, উৎসবে ছবি তোলার সময় একটা কথা মুখ থেকে আপনাআপনিই বেরিয়ে আসে। ‘সে চিজ’! ব্যস, হাসি হাসি মুখে সবার ছবি উঠে গেল মোবাইলে বা ডিজিটাল ক্যামেরায়। ‘চিজ’-এর আনন্দে সেই কবে থেকে মেতে আছে দুনিয়া। আর সত্যিই তো, হাসলে সবাইকে কত সুন্দরই না দেখায়। আর প্রিয় মানুষদের সঙ্গে সেই হাসি ছবিতে ধরা থাকলে তো আরওই ভালো। কিন্তু বিশ্বজোড়া প্রসিদ্ধ এই শব্দের পেছনের গল্পটি কী? কারণ খুঁজতে গিয়েই উঠে আসে ক্যামেরার এক অদ্ভুত ইতিহাস এবং এক সফল বিজ্ঞাপনী প্রচারের কাহিনি…

আদি অনন্তকাল ধরে এই ‘সে চিজ’ (Say Cheese) প্রচলিত এমনটা কিন্তু নয়। বরং একটা সময়ের ছবি দেখলে যথেষ্ট সন্দেহ হয়, মানুষের জীবনে হাসি বলেও কোনো বস্তু আছে? অদ্ভুত লাগলেও বিংশ শতকের আগে এমনটাই ঘটত। যে সময়টা ইতিহাসে ভিক্টোরিয়ান যুগ বলে প্রসিদ্ধ, সেই সময় এবং তার পরেও দেখা যাবে মুখ বন্ধ করে, একটুও না হেসে একেকজনের ছবি তোলা হয়েছে। ক্যামেরার দিকে কি তাকিয়ে কেউ হাসত না? ‘সে চিজ’ না থাকুক; ফটোগ্রাফার নিজেও তো বলতে পারতেন ‘একটু হাসুন’। এর পেছনে ইতিহাসবিদরা দুটো কারণ দেখেছেন। প্রথমত, ভিক্টোরিয়ান যুগে মুখ বন্ধ রেখে সুস্থিরভাবে ছবি তোলাটাই ছিল সামাজিক কেতা। সেটাই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল তখন। শিশুদের ক্ষেত্রে সেই বাধানিষেধের বালাই ছিল না বলে তাদের ক্ষেত্রে হাসিমুখের ছবি পাওয়া যায়। দ্বিতীয় ও মূল কারণ, সেই সময়ের প্রযুক্তিগত সমস্যা। এখনকার মতো আধুনিক ক্যামেরা তখন সায়েন্স ফিকশন। যে ক্যামেরা ব্যবহার করা হত, তার এক্সপোজার টাইম ছিল এখনকার থেকে অনেক বেশি। আরও ভালোভাবে বললে, একেকটা ছবি তুলতে আট-দশ সেকেন্ড, কখনও তারও বেশি লাগত। 

কাজেই অতক্ষণ ধরে কে আর হাসবে? এখন ছবি তুলতে দেরি হলেই আমরা অধৈর্য হয়ে যাই। হাসি ধরে রাখতে গেলে তো গাল ব্যথা করবে! তার ওপর মুখ কেঁপে গেলেই ছবি খারাপ আসার সম্ভাবনা। কাজেই হাসি আটকে রাখো। এরই মধ্যে ১৮৮৮ সালে জর্জ ইস্টম্যান বলে এক সাহেব তৈরি করেন একটি ফটোগ্রাফিক ফিল্ম তৈরির কোম্পানি। নাম ‘কোডাক’। তবে শুধুমাত্র ফিল্ম তৈরিতেই আটকে থাকেনি কোডাক। একটা সময় পর ক্যামেরাও আনতে থাকে বাজারে। আর এখানেই তৈরি হয় একটা বিপ্লব; যা বিশ্বের ফটোগ্রাফির মানচিত্রটাই বদলে দেয়। প্রযুক্তির উন্নতি ঘটিয়ে ১৮৯৫ সালে কোডাক বাজারে নিয়ে আসে তাদের প্রথম পকেট ক্যামেরা। বিংশ শতকের শুরুর দিকে আবারও একটা বিপ্লব। কোডাক নিয়ে এল ব্রাউনি ক্যামেরা; দাম মাত্র এক ডলার! সবাই ছবি তুলতে পারবে এতে। আরও বড়ো কথা, আগের মতো একটা ছবি তোলার জন্য আট-দশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে না। একটা ক্লিকেই উঠে যাবে ছবি। 

এখান থেকেই শুরু হল বিজ্ঞাপনী ক্যাম্পেইন। কোডাকের মূল মন্ত্র ছিল দুটি— ‘ইউ পুশ দ্য বাটন, উই ডু দ্য রেস্ট’। আর অন্যটি, ‘সে চিজ’! সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে যায় সেই বিজ্ঞাপন। বিশাল সাফল্য পায় কোম্পানিটি। সবথেকে বড়ো কথা, মুখ বন্ধ করে গম্ভীর হয়ে ছবি তোলার যুগের অবসান ঘটে। একটা ক্লিকেই যখন ছবি উঠে যাচ্ছে, তখন আর হাসতে মানা কোথায়! রামগরুড়ের ছানা হবার দিন ফুরিয়ে এল নতুন সূর্য। তবে ‘সে চিজ’ জনসমাজে প্রবলভাবে উঠে আসে চল্লিশের দশকে। দ্য বিগ স্প্রিং হেরাল্ড নামের একটি দৈনিকে এই শব্দটি বেরনোর পর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ব্যস, তখন থেকে আজ অবধি ক্যামেরা আর হাসির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এটি। তবে কোডাক যদি তখন ওই ক্যামেরা বের না করত, আরও কতদিন গম্ভীর মুখে ছবি তুলতে হত সবাইকে, কে জানে!   

আরও পড়ুন
বিশ্বের ‘সবচেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ফটোগ্রাফ’! সম্মিলিত আইকিউ আজও ধরাছোঁয়ার বাইরে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
আজও ১৬০ বছরের পুরনো পদ্ধতিতেই ছবি তোলেন এই ফটোগ্রাফার