বাস্তবের প্রেরণাতেই তৈরি ব্যাটম্যানের শহর ‘গথাম’

রাতের আঁধারে ক্রমশ বেড়ে চলেছে অপরাধের মাত্রা। প্রতিটি অলি-গলিতে গজিয়ে উঠেছে দুষ্কর্মের আখড়া। ব্যভিচার আর দুর্নীতিতে ধ্বংসের পথে গথাম (Gotham) শহর। এখন কে বাঁচাবে তাকে? হঠাৎই অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে জ্বলে উঠল আলো। অপরাধীরা মুখ তুলে দেখল এক বাদুড়ের চিহ্ন। তাদের চোখের প্রতিটি পলকে ধরা পড়ল ভয়। তিনি আসছেন শহরকে দুষ্কৃতিমুক্ত করতে। অত্যন্ত তীক্ষ্ণ তাঁর বুদ্ধি, সঙ্গে অত্যাধুনিক ‘গ্যাজেট’ আর পরনে কালো পোশাক। শত্রুকে জব্দ করে বলে উঠবে সেই অমোঘ শব্দ, “আই অ্যাম ব্যাটম্যান”। 

১৯৩৯ সালে বব কেন (Bob Kane) আর বিল ফিঙ্গারের (Bill Finger) যুগলবন্দিতে যে যাত্রার শুরু, তা নিয়ে আজও উন্মাদনার শেষ নেই। ডিসি কমিকসের (DC Comics) ব্যাটম্যান (Batman) যেন কল্পনার গণ্ডি পার করে প্রহরী হয়ে উঠেছেন সমস্ত শহরের। কমিকসে, সিনেমায়, অ্যানিমেশনে, ভিডিও গেমে পর্যন্ত জনপ্রিয়তার শীর্ষে রহস্যময় চরিত্রটি। অথচ তাঁর ধ্যানজ্ঞানে শুধুই গথাম শহরের নিরাপত্তা। বলা হয়, গত শতকের তিনের দশকে নিউ ইয়র্কের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিকে সামনে রেখেই তৈরি হয়েছিল কল্পনার গথাম শহর। আশ্চর্যের বিষয় হল, সত্যিই অস্তিত্ব রয়েছে গথাম নামের একটি গ্রামের। শুধু নামে নয়, ব্যাটম্যানের কমিকসের সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে এই গ্রামের সম্পর্ক।

ইংল্যান্ডের নটিংহ্যামশায়ারের নিরিবিলি এক গ্রাম গথাম। কমিকসের শহরের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই। জীবন এখানে বড্ড নিরুদ্বেগ। অতিথিবৎসল গ্রামবাসীদের জোকার বা পেঙ্গুইন ভাবতে গেলে আকাশকুসুম কল্পনা দরকার। গ্রামটির নাম অবশ্য আগে গথাম ছিল না, ছিল ‘গোট-আম’ (Goat-um)। অর্থাৎ ছাগলের গ্রাম। পশুপালনই ছিল এদের মূল জীবিকা। কিন্তু বিপদ বাঁধল ১৩০০ সাল নাগাদ। ইংল্যান্ডের সিংহাসনে তখন কিং জন। মধ্যযুগের প্রথা অনুযায়ী রাজা যে পথ দিয়ে যাবেন, সেই পথ সরাসরি রাজপরিবারের সীমানার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হবে। তো সেবার রাজা জন ঠিক করলেন গথামের উপর দিয়ে দূর কোনো গন্তব্যে যাবেন। এমনকি গুজব শোনা গেল যে বিশ্রামের জন্য এখানে একটি তাঁবু বানিয়ে বেশ কয়েকদিন থাকতে পারেন তিনি।

রাজা আসছেন, গ্রামের উপর দিয়ে যাবেন রাজকীয় সমারোহে। খুশি হওয়ার বদলে কিছুটা ক্ষুব্ধই হলেন গথামের বাসিন্দারা। কতটা জমি হাতছাড়া হয়ে যাবে বলা মুশকিল। কত লোকের রুটিরুজি চিরদিনের মতো বন্ধ হয়ে যাবে রাজার কয়েকদিনের বিলাসব্যসনে। তাহলে উপায়? অনেক ভেবে এক বুদ্ধি আবিষ্কার করল গ্রামবাসীরা। তখন লোকে বিশ্বাস করত পাগলামি অত্যন্ত ছোঁয়াচে এক অসুখ। সেটাকেই হাতিয়ার করল তারা। জনের আগমনের কিছুদিন আগে নাইটরা গ্রাম পরিদর্শনে এসে দেখল এক অদ্ভুত দৃশ্য। রাজাকে স্বাগত জানানোর কোনো ব্যবস্থা তো দূরের কথা, বরং প্রত্যেকে উন্মাদের মতো আচরণ করছে। কেউ ঈল মাছ ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করছে, কেউ-বা বুক সমান বেড়া দিয়ে কোকিলের উড়ে যাওয়া আটকানোর মরিয়া চেষ্টা করছে। চালটা খেটে গেল। নাইটরা গিয়ে খবর দিল গথাম গ্রামের মানুষদের ‘পাগলামি’-র বিষয়ে। রাজাও সে পথে পা বাড়ালেন না আর।

আরও পড়ুন
আদালতের আইনি নথিতে কমিকস, চমকে উঠলেন স্বয়ং বিচারপতি!

১৫৬৫ সালে এ.বি ফিজিকে ডক্টুর এই গল্পগুলিকে সংগৃহিত করে প্রকাশ করেন ‘মেরি টেলস অফ দ্য ম্যাড মেন অফ গথাম’ নামের একটি গ্রন্থ। সেই থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বয়ে আসছে রাজা তাড়ানোর গল্প। ক্রমে বিদেশেও জনপ্রিয়তা পায় কাহিনিগুলি। ১৮০৭ সালে আমেরিকান লেখক ওয়াশিংটন আর্ভিং তাঁর ‘সালমাগুন্ডি পেপার’-এ নিউইয়র্ক শহরের অবস্থা বোঝাতে প্রথম ব্যবহার করেন গথাম গ্রামের প্রসঙ্গ। সেই সময়ের নিউইয়র্কের রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে যে অব্যবস্থা চলছিল, তার তুলনা একমাত্র চলতে পারে গথামের ‘পাগলামি’-র সঙ্গে। ক্ষমতা আর রিপুর দাপটে কেউ আর সুস্থ মস্তিষ্কে নেই। যেন কয়েক হাজার মানুষ নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করতে অদ্ভুত সব কাজে মেতে আছে প্রত্যেকদিন। সেই শুরু। তারপর থেকে নিউইয়র্কের ডাকনামই হয়ে যায় ‘গথাম’। এমনকি সেই নামে দোকানও ছিল আমেরিকার এই শহরে।

আরও পড়ুন
উপসর্গ হাঁচি-কাশি, মারণ ভাইরাস হানা দিয়েছিল ব্যাটম্যানের শহরেও

সেখান থেকেই ব্যাটম্যানের শহরের নামের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বব কেন আর বিল ফিঙ্গার। এমনকি ডেনিস ও’নিলের লেখা ব্যাটম্যান ক্রনিকলস ৬-এর ‘সিটিস্কেপ’ কাহিনিতে স্বীকৃতিও দেওয়া হয় প্রচলিত গল্পটিকে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় কমিকসটি। কিছু বছর আগে গথাম গ্রামে ‘ভিলেজ অফ লেজেন্ড’ নামের একটি স্থাপত্য তৈরি হয়। যেখানে ব্যাটম্যানের যোগাযোগের সঙ্গে বলা হয়েছে কিং জনের কাহিনিও। কীভাবে স্থানীয় মানুষদের বুদ্ধিতে পালিয়ে গেছিল নাইটরা। কীভাবে তারা রক্ষা করেছিল গ্রামের জমি। আসলে এরাই তো সত্যিকারের ব্যাটম্যান। যেন তাদের উদ্দেশ্য করেই বলতে হয় ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমার শেষ সংলাপগুলি, “He’s the hero Gotham deserves, but not the one it needs right now.”

Powered by Froala Editor