কলকাতার বুকে অর্গ্যানিক বাজার, প্রান্তিক কৃষকদের দিশা দেখাচ্ছেন টালার প্রযুক্তিবিদ

রাস্তার একধারে ছোট্ট একটি টিনের শেড। টেবিল-চেয়ার নিয়ে সেখানেই বসেছে ছোট্ট একটি অস্থায়ী বাজার। ফল, শাক-সবজি থেকে শুরু করে চাল-ডাল— রয়েছে সবকিছুই। পোস্টারে বড়ো বড়ো লেখা ‘বসুন্ধরা’ (Basundhara)। বেলগাছিয়ার পাইক পাড়া টালা প্রত্যয় পার্কে (Tala Park) প্রতি সপ্তাহান্তে হাজির হলেই দেখা যাবে এই দৃশ্য। কিন্তু আর পাঁচটা বাজারের সঙ্গে ‘বসুন্ধরা’-র তফাৎ কোথায়?

একটু মন দিয়ে পোস্টারের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে বিষয়টি। কোনো রাসায়নিক সার কিংবা কীটনাশক নয়, এই বাজারে প্রাপ্ত সমস্ত সামগ্রীই তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ জৈব পদ্ধতিতে। হ্যাঁ, কলকাতার বুকে অর্গ্যানিক বাজার! পরিবেশ দূষণ রোধ, কার্বন ফুটপ্রিন্ট নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বোপরি কৃষকদের উচ্চ লাভের হদিশ দিতে পারে জৈব উৎপাদন। বিগত এক দশকে বিশ্বের একাধিক গবেষণাই ইঙ্গিত দিয়েছে এমনটা। তবে সিকিম সেই পথে হাঁটলেও, বাংলা কিংবা ভারতের অন্যান্য রাজ্য এখনও পিছিয়ে রয়েছে এক্ষেত্রে। এবার প্রান্তিক কৃষকদের কথা মাথায় রেখেই তাই কলকাতার বুকে জৈব বাজার স্থাপনের উদ্যোগ নিলেন উত্তর কলকাতার জনৈক প্রযুক্তিবিদ রবীন বন্দ্যোপাধ্যায় (Rabin Bandyopadhyay)। 

“কর্মসূত্রে পুরুলিয়া গিয়ে দেখেছিলাম, গোটা কৃষি ব্যবস্থাটাই নিয়ন্ত্রণ করছে কিছু প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। বীজ, সার, কীটনাশক সবটাই তাঁরা চড়া দামে বিক্রি করে। তাতে কৃষকদের লাভের পরিমাণ এতটাই কমে আসে যে কৃষকরা কলকাতায় এসে দিনমজুরের কাজ করতে বাধ্য হন।”


আরও পড়ুন
কৃষিক্ষেত্রে প্যাথোজেনের আক্রমণ ঠেকাবে ন্যানোপার্টিকল, অভিনব আবিষ্কার কানপুর আইআইটির

বলছিলেন রবীনবাবু। আজ থেকে বছর আটেক আগে এই সমস্যার সমাধান করতেই শুরু হয়েছিল তাঁর লড়াই। কৃষকদের বিকল্প উপার্জনের সমাধান খুঁজে দিতেই জৈব কৃষি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিলেন তিনি। প্রাথমিকভাবে শুকনো ফুল বা ড্রাই ফ্লাওয়ারের প্রক্রিয়াকরণ নিয়েই শুরু হয়েছিল তাঁর কাজ। পুরুলিয়ার প্রায় ২০০ উপজাতি সম্প্রদায়ের মহিলাকে ট্রেনিং দিয়েছিলেন ড্রাই ফ্লাওয়ার প্রক্রিয়াকরণের। সেইসঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের বিপণনেরও ব্যবস্থা করে দেন তিনি। 

আরও পড়ুন
জলমগ্ন জমিতে ‘ভাসমান’ কৃষিকাজ, বিকল্পের খোঁজে বাংলার চাষিরা

এই প্রকল্প সফল হওয়ার পরে সম্পূর্ণ জৈব উৎপাদনে জোর দেন রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “সার, বীজ কিংবা কীটনাশকের জন্য শিল্পপতিদের দ্বারস্থ না হয়ে, জৈব উপায়ে সেগুলি উৎপাদন করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।” সেই লক্ষ্য নিয়েই ঝালদার ২ নং ব্লকে ২০০ বিঘে জমিতে প্রান্তিক কৃষকদের দিয়ে ব্ল্যাক রাইস উৎপাদন করান তিনি। সম্বল বলতে ছিল সরকারি ধান্য গবেষণাকেন্দ্র থেকে আমদানি করা দানাশস্যের বীজ এবং কৃষকদের নিজেদের হাতে তৈরি করা জৈব কীটনাশক এবং সার। গোবর, ছত্রাক, জৈব আবর্জনা— এসব কিছু দিয়েই তৈরি সে-সব সার। তাতে একদিকে যেমন কৃষকদের উৎপাদনের খরচও অনেকটাই কমে আসে, তেমনই বাড়ে উৎপাদিত পণ্যের গুণগত মান। বর্তমানে পুরুলিয়ার মুরগুমা অঞ্চলের কয়েকশো কৃষক এই পদ্ধতিতেই উৎপাদন করে চলেছেন সম্পূর্ণ জৈব ফসল। 

আরও পড়ুন
অকালবৃষ্টিতে কৃষিকাজে ব্যাপক ক্ষতি, বদলে যেতে পারে চাষের সময়ও?

“তবে শুধু উৎপাদনের পথ দেখালেই তো হবে না, প্রান্তিক কৃষকদের বিপণনেরও তো একটা ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেখান থেকেই বসুন্ধরা বাজার তৈরির উদ্যোগ”, জানালেন রবীনবাবু। গত বছরই আগস্ট মাসে কলকাতার বুকে এই অস্থায়ী বাজার তৈরি হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। তবে পুজোর সময় জায়গার অভাবে বন্ধ হয়ে যায় কলকাতার একমাত্র সম্পূর্ণ জৈব বাজার। চলতি বছরে জানুয়ারি মাস থেকেই আবার দরজা খুলেছে সেই বাজারের। প্রশাসনের সাহায্যে মিলেছে অস্থায়ী শেডও। বর্তমানে সপ্তাহান্তে তিন দিন একবেলা করে জৈব পণ্যের পসরা নিয়ে বসছেন প্রান্তিক কৃষকরা। তবে লক্ষ্য, আগামীদিনে সপ্তাহের প্রত্যেকদিনই এই বাজার চালানোর। সেই উদ্দেশ্য সফল করতেই অক্লান্তভাবে লড়াই করে চলেছেন কলকাতার প্রবীণ প্রযুক্তিবিদ। তাঁর এই একক উদ্যোগ সত্যিই কুর্নিশ জানানোর মতোই…

Powered by Froala Editor