১৯৬৯ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন ভারত এক যুগান্তকারী মুহূর্তের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বিজ্ঞান গবেষণায় উন্নতি ছাড়া কোনো দেশই এগিয়ে যেতে পারে না। ততদিনে রাশিয়া আর আমেরিকার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে চাঁদে মানুষ পাঠানো নিয়ে। এই সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতে তৈরি হল একটি মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, ইসরো। কিন্তু মহাকাশ গবেষণার জন্য সব উন্নত সরঞ্জাম, রকেট – এইসব তৈরি হবে কোথায়? সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল দেশের অস্ত্র নির্মাণ সংস্থা ‘অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড’ (Ordnance Factory Board)। এরপর সেইল, ডিআরডিও সহ নানা গবেষণা সংস্থার সরঞ্জাম তৈরির কাজ করে এসেছেন তাঁরা। আর সংস্থার ইতিহাসও তো নয় নয় করে ২৪৬ বছর পার করল। এবার ছেদ পড়ল সেই ইতিহাসে। সরকারি নির্দেশে গতকাল থেকেই কাজ বন্ধ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডে। বরং সরকারি সংস্থার বদলে অস্ত্র নির্মাণের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হল ৭টি কর্পোরেট সংস্থার হাতে।
১৭১২ সালে ডাচ অস্টেন্ড কোম্পানির হাতে গড়ে ওঠে ভারতের প্রথম আধুনিক অস্ত্র নির্মাণ কারখানা। ইছাপুরের সেই কারখানা রমরম করে চলেছিল পলাশির যুদ্ধ পর্যন্ত। কিন্তু এরপরেই ভারতে, অন্তত বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিপত্য প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়। অনিশ্চিত হয়ে পড়ে ইছাপুরের কারখানার ভবিষ্যতও। তবে ১৭৭৫ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে তৈরি হল বোর্ড অফ অর্ডন্যান্স। ১৮০১ সালে তারই নাম বদলে রাখা হয় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ড। ভারতে তো বটেই, এই সংস্থার তৈরি অস্ত্রশস্ত্র পাড়ি দিত বিদেশেও। দুই মহাযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের যাবতীয় অস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল ভারতের কারখানাগুলি। স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত দেশে মোট ২৬টি অস্ত্র নির্মাণ কারখানা গড়ে তোলা হয়েছিল। দেশভাগের পর তার ১৮টি থেকে যায় ভারতে। এছাড়াও পরে আরও ২৩টি কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। সব মিলিয়ে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের হাতে কারখানার সংখ্যা ছিল ৪১টি।
তবে ২০০০ সাল থেকেই একাধিকবার দেশের অস্ত্র নির্মাণের দায়িত্ব বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব উঠেছে। পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য তৈরি হয়েছে ৪টি তদন্ত কমিটিও। সেই সমস্ত কমিটির রিপোর্ট মেনেই ২০১৯ সালে লোকসভায় অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের বিলুপ্তির প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়। তবে লোকসভায় প্রস্তাব পাশ হলেও দেশজুড়ে বিতর্ক বন্ধ হয় না। বিশেষ করে কারখানার কর্মচারীরা প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। ঐতিহাসিক এই সংস্থার ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি এ যে তাঁদের রুটিরুজিরও প্রশ্ন। তবে গত ১৬ জুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, বেসরকারিকরণের কারণে কোনো কর্মচারীকেই চাকরি খোয়াতে হবে না। এমনকি তাঁরা যে সামাজিক নিরাপত্তার সুবিধাগুলি ভোগ করছিলেন, তাও অক্ষুণ্ণ থাকবে। তবে ৩০ তারিখের অন্তিম ঘোষণায় সেই প্রতিশ্রুতি কার্যত অগ্রাহ্যই করলেন তিনি।
সর্বশেষ ঘোষণায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানিয়েছেন, অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের আওতায় থাকা ৭০ হাজার কর্মচারীকে আপাতত অন্য কোনো পিএসইউ-র আওতায় কাজের সুযোগ দেওয়া হবে। তবে সেই কাজ স্থায়ী নয়। ২ বছরের জন্য ডেপুটেশনের ভিত্তিতে নিয়োগ করা হবে তাঁদের। এই ২ বছরের মধ্যে যাঁদের অবসর নেওয়ার সময় এসে যাবে, তাঁরা পূর্ববর্তী শর্ত অনুসারে পেনশন এবং অন্যান্য সুবিধা পাবেন। কিন্তু বাকিদের এর মধ্যেই অন্যত্র কাজ খুঁজে নিতে হবে। অবশ্য এই বিষয়ে সরকারি তরফ থেকে সমস্ত রকমের সাহায্য করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
তবে পূর্ববর্তী ঘোষণায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আরও জানিয়েছিলেন, কেবলমাত্র উৎপাদনের বিষয়টি দেখার জন্যই ৭টি কর্পোরেট সংস্থার হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে চলেছে কেন্দ্র। তবে তার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব থাকবে পুরোপুরি সরকারি হাতেই। অথচ সরকার নিজের কর্মচারীদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এরপর দেশের নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কর্পোরেটের প্রভাব কেমন হতে পারে, তাই নিয়েও আশঙ্কা উঠছে। আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে ইসরো, সেইল, ডিআরডিও-র মতো প্রতিষ্ঠানগুলির ভবিষ্যত নিয়েও।
Powered by Froala Editor