এ যেন সিনেমার গল্প। বা বলা যায় উল্টোটা। বাস্তবের ঘটনাই উঠে আসে সিনেমায়। টাকা জাল করে বড়োলোক হওয়ার ‘ফরজি’ গল্প তো প্রায়ই দেখা যায় সিনেমা-ওয়েবসিরিজে। কিন্তু যদি সত্যিই জাল টাকায় ভরিয়ে দেওয়া যায় একটা গোটা দেশকে? চেষ্টা হয়েছিল সেরকমই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ৫ আর ১০ পাউন্ডের জাল নোটে ছেয়ে গেছিল ইংল্যান্ডের বাজারের। সৌজন্যে— হিটলারের নাৎসি জার্মানি। পরিকল্পনার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন বার্নহার্ড’ (Operation Bernhard)। যা সম্পূর্ণ সফল হলে পঙ্গু হয়ে যেত ব্রিটেনের অর্থনীতি। বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস হয়তো লেখা হত অন্যভাবে।
কিন্তু কি এই ‘অপারেশন বার্নহার্ড’? উত্তর খুঁজতে যেতে হবে ১৯৩৯-এর জার্মানিতে। তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে শুরু হয়ে গেছে ছক কষা। আক্ষরিক অর্থেই ‘কাগজে-কলমে’। কেমন হয়, যদি ইউরোপের দেশগুলোয় জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়া যায়? দুর্বুদ্ধি জন্মাল জার্মানির তদন্ত দপ্তরের প্রধান আর্থার নেবের মাথায়। সঙ্গে সঙ্গে খবর গেল ‘প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী’ গোয়েবলসের কাছে। শেষ শিলমোহরটি এল স্বয়ং হিটলারের থেকে। যদিও আন্তর্জাতিক শান্তিনীতির দোহাই দিয়ে আপত্তি করেছিলেন অর্থমন্ত্রী ওয়ালথার ফাঙ্ক। কিন্তু কে শোনে কার কথা! শুরু হল ‘অপারেশন’।
তখন অবশ্য নাম ছিল ‘অপারেশন আন্দ্রেস’। জার্মান ‘এসএস’ আলফ্রেড নাউজোকসের অধীনে শুরু হল কাজ। আর পুরোটার তত্ত্ববধানে ছিলেন হিটলারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হেইডরিক রেইনহার্ট। বার্লিনের কোনো অজানা স্থানে বসল টাকা তৈরির যন্ত্র। জোগাড় করা হল চিত্রশিল্পীদের, যারা হুবহু নকল করবে ব্রিটেনের নোটের ছাঁচ। এলেন এক গণিতবিদ, যার কাজ নোটের উপর থাকা নম্বরগুলির প্যাটার্ন বোঝা। এর সঙ্গে রইল একদল জালিয়াত, যারা পাসপোর্ট, দলিল ইত্যাদি জাল করতে সিদ্ধহস্ত। ঠিক করা হল শুধুমাত্র ৫ পাউন্ডের নোট জাল করা হবে, কারণ এগুলোই বাজারে চলে বেশি।
এদিকে ভয়ানক আকার ধারণ করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। হিটলার-মুসোলিনি মিলে মধ্য-ইউরোপ প্রায় দখল করে নিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে রয়েছে অনাক্রমণ চুক্তি, ওদের নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। ইংল্যান্ড দখল করলেই অর্ধেক কাজ সমাপ্ত হবে। কিন্তু সমুদ্রে ঘেরা শক্তিশালী নৌবহরের ইংল্যান্ডের সেনাকে পরাস্ত করা খুব একটা সহজ ছিল না। ফলে ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে আঘাত করতে তাকানো হল কাগজের অস্ত্রের দিকে। কিন্তু ততদিনে মাত্র ৩ মিলিয়ন পাউন্ড তৈরি করেছে আলফ্রেড। তাও ঠিকভাবে জাল করা যায়নি নোটগুলি। বিশেষ করে, কাগজের গুণমান আর কালিতে তো ধরা পড়তে বাধ্য। সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। ১৯৪২-এ মাত্র সাত মাসে চলেই বন্ধ হয়ে যায় ‘অপারেশন’।
আরও পড়ুন
মৃত পরিচয়ে বেঁচে ছিলেন ৪০ বছর, বিশ্বযুদ্ধের ‘পলাতক’ গুপ্তচরের কাহিনি
ইংল্যান্ড কিন্তু বহু আগেই সতর্কবার্তা পেয়েছিল। ১৯৩৯-এর নভেম্বরেই এক জার্মান-সোভিয়েত ‘ডবল এজেন্ট’ খবর পাঠিয়েছিল ব্রিটিশ দূতাবাসে। সেই অনুযায়ী বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। তবে, কিছুটা নিশ্চিন্তেই ছিল ইংল্যান্ডের অর্থদপ্তর। তাদের নোটে বস্তা থেকে তৈরি কাগজে ১৫০টা অত্যন্ত ছোটো চিহ্ন ছিল। সেগুলির স্থান প্রায়ই বদলে দেওয়া হত। এই কারসাজি বোঝা যে জার্মানদের অসাধ্য, এরকমই ভেবেছিলেন তারা। কিন্তু ১৯৪২-এ জার্মানিতে বার্নহার্ড ক্রুগার (Bernhard Kruger) অপারেশনের দায়িত্ব নিয়েই সমাধান করেন এই সমস্যার। আবার চালু হয় সব কিছু। নতুন নাম হয় ‘অপারেশন বার্নহার্ড’। এবারের ঠিকানা সাখসেনহসেন ক্যাম্প।
আরও পড়ুন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ‘উড়ন্ত’ ট্যাঙ্ক বানিয়ে চমক দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন
সম্পূর্ণ নতুন দল তৈরি করেন বার্নহার্ড। কাজে লাগানো হয় বন্দি ইহুদিদের। প্রথমে ২৬ জন, ৪ মাস পরে নিয়ে আসা হয় আরও ৮০ জনকে। শেষ পর্যন্ত কাজ করত মোট ১৪০ জন। এদের মধ্যে চোর-জালিয়াতরা তো ছিলই, ইহুদি গণিতবিদদের ছিল না রেহাই। চলত সারাদিন খাটনি। খেতে দেওয়া হত নামমাত্র। কাজে ঢিলেমি দিলে বাড়ানো হত অত্যাচারের মাত্রা। ক্রমে বানানো হল নকল কাগজ। কালির সমস্যাও দূর হল। নোটের অ্যালগোরিদম বুঝতে একটু সময় লাগলেও কাজ বন্ধ রইল না। এক বছরের মধ্যে তৈরি হল কয়েক হাজার জাল নোট। সুইস ব্যাঙ্ক মারফত সেগুলি চলে যেতে লাগল ইংল্যান্ডের বাজারে। সন্দেহ অবশ্য অনেকের হয়েছিল। কিন্তু খোদ ব্রিটিশ অর্থদপ্তরও প্রথমে ধরতে পারেনি জাল নোটের কর্মকাণ্ড।
১৯৪৩ সালের মধ্যে তৈরি হয় ৫ পাউন্ড আর ১০ পাউন্ডের প্রায় ৬৫০০০ জাল নোট। সেই সময়ের হিসেবে মূল্য দাঁড়াতে পারে ১৩৫ মিলিয়ন থেকে ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের মধ্যে। আজকের বাজারে ছাড়িয়ে যাবে ৩ বিলিয়ন পাউন্ড। চেষ্টা করা হয়েছিল আমেরিকার ডলার জাল করারও। কিন্তু ভাঙা যায়নি অ্যালগোরিদম। কিছুটা দেরিতে হলেও অবশেষে ঘুম ভাঙে ইংল্যান্ডের। দ্রুত বদলানো হয় নোটগুলি। বাইরে থেকে ১০ পাউন্ডের নোট আসা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
যুদ্ধও ততদিনে প্রায় শেষের পথে। পালাতে থাকেন বার্নহার্ড। সঙ্গে প্রচুর জাল নোট আর টাকা ছাপানোর যন্ত্র। ১৯৪৫-এর মার্চ মাসে ধরা পড়ার ভয়ে সমস্ত বাক্সবন্দি টাকা ভাসিয়ে দেওয়া হয় টপলিৎজ ও গ্রান্ডলসি লেকে। পরে অবশ্য উদ্ধার হয় সেগুলি। কিন্তু ইংল্যান্ডের অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন ভুগিয়েছিল ‘অপারেশন বার্নহার্ড’। ১৯৫৭-এ বদলে দেওয়া হয় ৫ পাউন্ডের নোটের রঙ। ক্রমে উধাও হয়ে যায় সমস্ত জাল নোট।
ভারতের মতো উপনিবেশের টাকায় ভরে থাকত ইংল্যান্ডের কোষাগার। হিসেব করলে অন্তত কয়েকশো কোটি টাকার দেনায় ডুববে ব্রিটিশরা। নেহাৎ সফল হননি বার্নহার্ড। ইতিহাসের গতিও চলেছে নিজের পথে। নাহলে চোরের উপর বাটপাড়ি-র আদর্শ নমুনা হয়ে থাকত ‘অপারেশন বার্নহার্ড’।
Powered by Froala Editor