ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসছে বুলেটের বৃষ্টি। জাহাজ থেকে নামার পরই মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে অজস্র রুশ সৈনিকের মৃতদেহ। ‘এনিমি অ্যাট দি গেটস’ সিনেমাটির কথা মনে আছে? সেখানেই দেখানো হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে স্তালিনগ্রাদের এই করুণ দৃশ্য। জার্মানির নৃশংসতায় প্রাণ হারিয়েছিলেন কাতারে কাতারে মানুষ। সে-যাত্রায় তাঁদের মৃতদেহের ভিড়ে মিশে গিয়েই প্রাণে বেঁচেছিলেন চলচ্চিত্রের নায়ক ভাসিলি। এবার যেন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি হল আবার। তবে প্রেক্ষাপট রাশিয়া নয়, ইউক্রেন!
গত মার্চ মাসের কথা। ইউক্রেনের রাজধানী কিভের নিকটবর্তী বুচা শহরতলিতে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছিল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। তবে সেই দাবি মানতে চায়নি ক্রেমলিন। এবার প্রত্যক্ষ প্রমাণ মিলল সেই নৃশংস ঘটনার। পাওয়া গেল ছবি, ভিডিও-সহ প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য প্রমাণ। বিপক্ষের সেনা নয়, বরং সাধারণ নাগরিকদেরই নৃশংসভাবে খুন করেছিল রুশ সেনারা।
ইভান স্কাইবা— সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে অন্যতম চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছেন এই ৪৩ বছর বয়সি ইউক্রেনিয়ান ট্যাক্সিচালক। এই গল্পের শুরু ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে। সেটা ছিল ২৪ তারিখ। ইউক্রেনের রাজধানী কিভে আছড়ে পড়েছিল অসংখ্য রুশ শেল। তবে কিভই যে যুদ্ধের পটভূমি হয়ে উঠবে, তা তখনও জানতেন না ইভান। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই রুশ সেনারা অনুপ্রবেশ করে কিভে। চরম মাত্রায় পৌঁছায় সংঘাত। সে-সময় বহু মানুষ দেশ ছাড়লেও, বাসস্থান বদল করেননি ইভান। স্ত্রী ও চার সন্তানকে অন্য শহরে নিরাপদে সরিয়ে রেখে ফিরে এসেছিলেন কিভে। তারপর ইউক্রেন সেনা বাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নেমেছিলেন উদ্ধারকার্যে। তাঁর সহায়তায় এই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন বহু মানুষ।
ইভান একা নন, তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও ৮ জন ইউক্রেনীয় নাগরিক। তাঁরাও বুচার সাধারণ বাসিন্দা। তবে রুশিদের বিরুদ্ধে লড়তে কেউ হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র, কেউ আবার গোপন আস্তানায় সাধারণ নাগরিকদের লুকিয়ে রাখার দায়িত্বে ছিলেন।
গত ৪ মার্চ রুশ বাহিনীর চিরুনি তল্লাশিতে ধরা পড়েন ইভান-সহ তাঁর ৮ সহযোদ্ধা। তাঁদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে প্রথমে প্যারেড করানো হয় বুচার রাস্তায়। তারপর নৃশংসভাবে এলোপাথাড়ি গুলি চালানো হয় তাঁদের দিকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল তাঁদের নিথর দেহগুলি। একমাত্র বেঁচেছিলেন ইভান। পায়ে ও কোমরে গুলি লেগেছিল তাঁর। রক্তক্ষরণ হলেও, স্বল্পের জন্য রেহাই মেলে মৃত্যুর থেকে। যন্ত্র সহ্য করেও মৃতের অভিনয় করতে হয়েছিল তাঁকে। তারপর রুশ সৈন্যরা চলে যাওয়ার ১৫ মিনিট পর কোনোক্রমে গোপন ডেরায় আশ্রয় নেন ইভান। দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকার পর সম্প্রতি সুস্থতায় ফিরেছেন তিনি।
গত মার্চ মাসেই প্রকাশ্যে এসেছিল এই ঘটনার একটি বিতর্কিত ছবি। সেখানে দেখা গিয়েছিল বন্দুকের নলের সামনে, একে অপরের কোমরবন্ধনী ধরে কুচকাওয়াজ করছেন ৯ ব্যক্তি। তবে তাঁরা যে ইউক্রেনীয়, সেই দাবি নস্যাৎ করে দেয় রুশ বাহিনী। এর প্রায় ৫ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর ইভানের দৌলতেই প্রমাণ মিলল এই ঘটনার। ইভানের বিবৃতি অনুযায়ী, বুচার ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাপ্ত একটি সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ থেকেও দেখা মিলেছে এই দৃশ্যের। তাছাড়াও খোদ ইভানই যেন এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
ইউক্রেনের দাবি, রাশিয়ার ১০৪ ও ২৩৪তম এয়ারবর্ন অ্যাসল্ট রেজিমেন্টের প্যারাট্রুপাররা জড়িয়ে ছিলেন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে। তাছাড়াও মার্চ জুড়ে বুচার বিভিন্ন অংশে প্রাণ হারিয়েছেন ১২০০ সাধারণ নাগরিক। তাঁদেরকেও হত্যা করেছে রুশ সেনারাই। সে-কথা প্রমাণ না হলেও, একাধিক নিউইয়র্ক টাইমস, আলজাজিরা-সহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অনুসন্ধানমূলক প্রবন্ধ স্বীকৃতি দিয়েছে ইভানের ঘটনাকে। তুলে এনেছে নানা খুঁটিনাটি তথ্য। রুশ সেনাদের এই নৃশংসতা নিঃসন্দেহেই যুদ্ধাপরাধ বা ওয়ার ক্রাইমের আওতায় পড়ে। এখন দেখার এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলি আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেয় কিনা…
Powered by Froala Editor