অখণ্ড ভারতে তখনও দানা বাঁধেনি ব্রিটিশরাজ। আউধে তখন শাসন চলছে নবাব ওয়েজেদ আলি খাঁ’র। সেসময় কেমন ছিল বাংলা? নবাব ওয়াজেদ আলিরই হেঁশেলে কাজ করা এক তরুণ ফরাসী বাবুর্চির চোখ দিয়ে তৎকালীন বাংলার সমাজকে দু’মলাটে বন্দি করছেন লেখক, গবেষক এবং কিউরেটর এবাদুর রহমান। তাঁর লেখা প্রকাশিতব্য তৃতীয় উপন্যাসে ‘মজনু শাহ ফকিরা’-তে ফিরে ফিরে এসেছে গোপাল ভাঁড়-সহ তৎকালীন বাংলার বুদ্ধিজীবী, ফকির এবং বৌদ্ধ তান্ত্রিকদের কথা।
উপন্যাসের বিষয়বস্তু, প্রেক্ষাপট শুনেই পড়বার আগ্রহ লাগছে নিশ্চয়ই? লাগারই কথা। এমন অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইতিহাসের মিশেল আর কটাই বা দেখা যায়! কিন্তু এইটুকুতেই শেষ নয়, রচনা থেকে মুদ্রণ পরিকল্পনা— বইটির ছত্রে ছত্রেই লুকিয়ে রয়েছে অভিনবত্ব। শেষ থেকেই শুরু করা যাক না হয়। স্বয়ং লেখকই সম্প্রতি ফেসবুকে ঘোষণা করেছেন, এই বইটি ছাপা হবে মাত্র ১৭টি কপি। তার মধ্যে অবশ্য তিনটি বিক্রয়যোগ্য নয়। তবে এখানেও রয়েছে সূক্ষ্ম একটি শর্ত। বাকি ১৪টি কপির জন্য আগাম পাঠকের বন্দোবস্ত না হলে, এই বই ছাপা হবে না বলেই জানাচ্ছেন লেখক।
এবার ঢুকে পড়া যাক বইয়ের পাতায়। সেখানেও রয়েছে একটি বিশেষ আকর্ষণ। সাধারণ পাঠকের চোখে ঠিক বোধগম্য না হলেও, কোনো ক্যালিগ্রাফার বা টাইপোগ্রাফি বিশেষজ্ঞের দৃষ্টি আটকাবেই বইয়ের হরফে। কারণ, সেই বাংলা ফন্ট নির্মাণ করেছেন স্বয়ং লেখক। তাছাড়া এই বইয়ের কাগজ এবং ছাপার কালিতেও থাকছে বিশেষত্ব। প্রথমত হাতে তৈরি অ্যাসিড-ফ্রি কাগজে ছাপা হবে এই বই। আর ছাপার কাজে যে কালি ব্যবহৃত হবে তা তৈরি জাফরান এবং মধু দিয়ে। ব্যবহৃত হত রেনেসাঁর যুগে। বইটি বাঁধাইয়ের ক্ষেত্রেও রয়ে যাচ্ছে রেনেসাঁরই ছাপ। ইতালিয় এক শিল্পী মরোক্কান লেদারে বাঁধাই করবেন এই বই। প্রায় ৬০০ বছর ধরে বংশানুক্রমে তাঁর পরিবার যুক্ত বাঁধাইয়ের এই পেশার সঙ্গে।
‘মজনু শাহ ফকিরা’ গ্রন্থটির দাম ধার্য করা হয়েছে ১ লক্ষ ১০ হাজার বাংলাদেশি টাকা, ভারতীয় মুদ্রায় যা প্রায় ৯৪,২৪৮ টাকার সমান। অবশ্য বাংলাদেশের বাইরে কিনতে গেলে খরচ হবে ৩ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা অর্থাৎ সাড়ে তিন হাজার মার্কিন ডলার। দাম শুনেও বিস্ময় লাগছে নিশ্চয়ই? কিন্তু অবাক হওয়ার কিছুই নেই। একদিকে যেমন এই বইয়ের মুদ্রণপ্রক্রিয়া হতে চলেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তেমনই এই গ্রন্থের নির্মাণের পিছনেও লুকিয়ে রয়েছে লেখকের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং গবেষণা।
এই বইটির জন্যই তাঁকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। কখনো ব্রিটিশ ন্যাশনাল লাইব্রেরি; কখনো ফ্রান্স, জার্মানি, নেদারল্যান্ডসের সংগ্রহশালা থেকে তিনি খুঁড়ে বার করেছেন ইতিহাস, সংস্কৃতির হদিশ। বইটিতে ব্যবহারের জন্য চিত্রকলা সংগ্রহ করেছেন ব্রিটিশ লাইব্রেরি, বিবলিওথেক ন্যাশিওনাল থেকে। তার পারিশ্রমিকও তো যুক্ত হওয়ারই কথা বইটির বিক্রয়মূল্যের সঙ্গে।
এবার সব শেষে আসা যাক বইটির মূল রচনায়। শুনলে অবাক লাগতে পারে, এতকিছু পরিকল্পনার পরেও এখনও পর্যন্ত শেষ হয়নি এই বই লেখার কাজ। যদিও নির্ধারিত আছে উপন্যাসের ভাগ্য, তাও বর্তমানে পাণ্ডুলিপিতে কলম ছোঁয়াচ্ছেন না লেখক। আগামী ৭ সেপ্টেম্বর বইয়ের শেষ তিনটি পাতা রচনার কাজ করবেন তিনি। প্রশ্ন ওঠে কেন বেছে নেওয়া এমন বিশিষ্ট কোনো তারিখ? সেই জায়গাটিও পরিষ্কার করে দেন লেখক স্বয়ং, “এই বইয়ের শেষ শব্দ ও প্রথম শব্দ এক, কিন্তু, শব্দের ওজন আলাদা রাখতে ৭ই সেপ্টেম্বরই লিখে শেষ করতে হবে”। এক্ষেত্রে অনেকটাই যেন তিনি স্বপ্নদিষ্ট। বই মুদ্রণের ক্ষেত্রেও রয়েছে এমনই পূর্ব-নির্ধারিত তারিখ। আগামী ২১ ডিসেম্বরের আগেই তা শেষ হবে। কেন না এই দিনেই ইছামতীর পাড়ে একই পাত্রে জল পান করেছিলেন মজনু শাহ ফকিরা এবং ভবানী পাঠক।
আরও পড়ুন
একমাত্র বাঙালি শিশু বিজ্ঞানী হিসেবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানমেলায় বীরভূমের অনিরুদ্ধ
সব মিলিয়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রহস্যে মোড়া এই গ্রন্থ। তাঁর লেখা প্রথম দুটি বই ‘দাস ক্যাপটাল’ (২০০৫) এবং ‘গুলমোহর রিপাবলিক’-এও (২০১১) ধরা দিয়েছিল অভিনবত্বের ছাপ। তবে গ্রন্থ নির্মাণ, গবেষণা এবং শিল্পচর্চা ছাড়াও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজ করেছেন তিনি। ‘গেরিলা’ ছবির জন্য সংলাপ এবং চিত্রনাট্যের জন্য পেয়েছেন বাংলাদেশের জাতীয় পুরস্কার। বর্তমানে গবেষণার কাজে দেশের বাইরে ক্যালিফোর্নিয়া এবং ভিয়েনাতেই রয়েছেন বলে জানিয়েছেন এবাদুর। তবে বাংলার সঙ্গে যে এতটুকু সম্পর্কচ্ছেদ হয়নি তাঁর— তা সহজেই অনুমেয় তাঁর প্রকাশিতব্য উপন্যাস ‘মজনু শাহ ফকিরা’-র প্রেক্ষাপট থেকেই। হাতে গোনা সামান্য কয়েকজন পাঠকই হয়তো সুযোগ পাবেন এই গ্রন্থ পড়ে দেখার, কিন্তু বাংলা সাহিত্যে ‘মজনু শাহ ফকিরা’ যে ঐতিহাসিক একটি মাইলস্টোন তৈরি করতে চলেছে তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor